এই জাতীয় স্বপ্নের কোনো মানে হয়?
হোসেন সাহেব বসার ঘরে ঢুকে দেখলেন মাঝবয়েসী এক জন অপরিচিত লোক বসে আছে। লোকটি খুব কায়দা করে সিগারেট টানছে এবং পা নাচাচ্ছে। হোসেন সাহেবকে দেখে সিগারেট ফেলে। লাফ দিয়ে উঠে দাঁড়াল। বিস্মিত হোসেন সাহেব বললেন, জনাব, আপনার নাম?
স্যার, আমার নাম সাদেক আলি।
বলতে-বলতে লোকটি এগিয়ে এসে পা ছুঁয়ে সালাম করল। তিনি হকচকিয়ে গেলেন। বিব্রত কণ্ঠে বললেন, আপনাকে তো চিনতে পারলাম না!
আমি দি অ্যারনইন্টারন্যাশনালের জেনারেল ম্যানেজার।
ও, আচ্ছা আচ্ছা।
স্যার কি আছেন?
শফিক তো চিটাগাং গিয়েছে।
আমি রফিক স্যারের কাছে এসেছিলাম।
ওর কাছে কী জন্যে?
দি অ্যারন ইন্টারন্যাশনালের ব্যাঙ্কলোন পাওয়া গেছে, এই সুখবরটা স্যারকে দেবার জন্যে এসেছিলাম।
হোসেন সাহেব কিছুই বুঝলেন না। অবাক হয়ে তাকিয়ে রইলেন।
বেশিক্ষণ বসতে পারব না। স্যারকে খবরটা দিয়ে দেবেন। স্যার এটা নিয়ে খুব দুশ্চিন্তা করছিলেন।
কী খবর দেব?
বলবেন, ব্যাঙ্কলোনটা হয়েছে।
জ্বি আচ্ছা, বলব। একটু চা খান।
চা আমি খাই না, তবে আপনি মুরুরি মানুষ বলছেন, এই জন্যই খাব।
সাদেক আলি কিছুক্ষণের মধ্যেই জমিয়ে ফেলল। হোসেন সাহেবের সঙ্গে পুরোপুরি একমত হল যে, দেশ থেকে এ্যালোপ্যাথি চিকিৎসা তুলে দেওয়া দরকার। প্রতি ডিসটিক্টে থাকা দরকার একটা করে হোমিও হাসপাতাল। দরকার একটি হোমিও ইউনিভার্সিটির হোসেন সাহেব লোকটির আদব-কায়দা ও ভদ্রতায় মুগ্ধ হলেন। রাতে ভাত খাবার সময় নীলুকে বললেন, ম্যানেজার সাহেব বিশিষ্ট ভদ্রলোক।
কোন ম্যানেজার?
সাদেক আলি সাহেব। রফিকের কাছে ব্যাঙ্কের কী-একটা কাজে এসেছে। আমার তো মা মনে থাকবে না। তুমি রফিককে বলে দিও।
কী বলব?
ম্যানেজার সাহেব এসেছেন, এটা বললেই হবে।
রফিক এল রাত এগারটার দিকে। সে হাসপাতালে কবির মামাকে দেখতে গিয়ে আটকা পড়ে গিয়েছিল। কবির মামার জ্বর হঠাৎ বেড়ে গেছে। আরোলতাবোল কথা বলছেন। অনেকটা বক্তৃতার ঢং সাধু ভাষার বক্তৃতা-সুধী সমাজের নিকট আকুল আবেদন। হে বন্ধু হে প্রিয়। সংযত হোন। বন্ধ করুন। শরৎকালের এই সুন্দর মেঘমুক্ত প্রভাত–
রফিক ঘাবড়ে গিয়ে বলল, ব্যাপার কী? মাঝবয়েসী এক জন ডাক্তার শুকনো মুখে বললেন, বুঝতে পারছিনা, ডিলেরিয়াম মনে হচ্ছে। ডিলেরিয়াম হবার মতো জ্বর তো নয়। এক শ দুই।
কিছু একটা করুন। মামার এই কুৎসিত বক্তৃতা শোনা যাচ্ছে না। হাসি এসে যাচ্ছে। এখানে হাসা ঠিক হবে না।
ডাক্তার বিরক্ত মুখে তাকালেন।
আপনি রোগীর কে হন?
ভাগ্নে হই।
আমার মনে হয়, রোগীকে বাড়ি নিয়ে ফ্যামিলির কেয়ারে রাখাই ভালো।
শেষ অবস্থা নাকি?
কী ধরনের কথা বলছেন? শেষ অবস্থা হবে কেন?
এখনি বাড়ি নিয়ে যেতে বলছেন। এই জন্যেই জিজ্ঞেস করছি।
কাল-পরশু নিয়ে যান।
সেখানে যদি এ-রকম বক্তৃতা শুরু করেন, তখন কী করব?
ডাক্তার সাহেব বেশ কিছু সময় কঠিন চোখে তাকিয়ে থেকে বললেন, দয়া করে আমার সঙ্গে রসিকতা করবেন না। আপনি বাইরে গিয়ে বসুন।
বাইরে তো বসার কোনো ব্যবস্থা নেই।
বসার ব্যবস্থা না-থাকলে হাঁটাহাঁটি করুন।
রফিক আর কথা বাড়াল না। হাসপাতালের বারান্দায় রাত সাড়ে দশটা পর্যন্ত দাঁড়িয়ে রইল। ফেরার আগে দেখে এল কবির মামা শান্ত হয়ে ঘুমুচ্ছেন। এখন সে বাড়ি চলে গেলে দোষ হবে না।
দরজা খুলে দিল শারমিন। শারমিনের মুখ গভীর। ঘুমে চোখ বন্ধ হয়ে আসছে। সে হাই চাপতে-চাপতে বলল, খাবে? না খেয়ে এসেছ?
রফিক তার জবাব না দিয়ে বাথরুমে ঢুকল। তাদের দুজনের মধ্যে এখন কথাবার্তা প্ৰায় নেই বললেই হয়। প্রায় রাতেই রফিক বাড়ি ফিরে দেখে শারমিন ঘুমিয়ে পড়েছে। আজই ব্যতিক্রমী ঘটনা ঘটল। এখনও জেগে আছে।
শারমিন তোয়ালে হাতে দাঁড়িয়ে ছিল। রফিককে তোয়ালে এগিয়ে দিতে-দিতে বলল, ভাত খাবে?
হ্যাঁ, খাব। তোমার থাকার দরকার নেই, ঘুমিয়ে পড়। যা হয় আমিই ব্যবস্থা করব।
তোমাকে একটি কথা বলার জন্যে জেগে আছি।
বল।
খেতে বস, বলছি।
সিরিয়াস কিছু?
না, খুবই সাধারণ! তোমার সঙ্গে সিরিয়াস কথা কী বলব?
খুবই সাধারণ কথাগুলি রফিক শুনল। হ্যাঁ-না কিছুই বলল না। শারামিনের রক্তব্যের সারমর্ম হচ্ছে সে পি-এইচ.ডি করার জন্যে দেশের বাইরে যাবে। খাওয়া এবং ঘুমানোর এই রুটিন তার আর ভালো লাগছে না।
রফিক হাত ধুতে-ধুতে বলল, যাবে কী ভাবে?
শারমিন বলল, অন্য সবাই যেভাবে যায় সেইভাবেই যাব। প্লেনে করে। হোটে-হেটে যাওয়া তো সম্ভব নয়।
সব ঠিকঠাক নাকি?
মোটামুটি ঠিকঠাক বলতে পার। ইউনিভার্সিটি অব ওয়াশিংটনের ফরেন স্টুডেন্ট এ্যাডভাইজার আমাকে একটা চিঠি দিয়েছেন। তাতে লিখেছেন, আমার একটা টিচিং এ্যাসিসটেন্টশিপ পাওয়ার সম্ভাবনা আছে।
চিঠি কিবে এসেছে?
সপ্তাহখানেক আগে।
এই এক সপ্তাহ বসে-বসে ভাবলে?
হ্যাঁ। আমি ঘুমুতে গেলাম। তুমি বাতি নিবিয়ে এস।
রফিক বসার ঘরে দীর্ঘ সময় বসে রইল। এক বার ভাবছিল জিজ্ঞেস করবে।–ব্যবস্থা কে করে দিলেন, সাব্বির সাহেব? শেষ মুহূর্তে নিজেকে সামলে নিল। সাব্বির প্রসঙ্গে সে কোনো দিন কিছু বলবে না, এ-রকম প্রতিজ্ঞা এক বার করেছে। প্রতিজ্ঞা করা হয় প্রতিজ্ঞা ভাঙার জন্যেই। কিন্তু এই প্রতিজ্ঞা সে ভাঙবে না। তার চা খেতে ইচ্ছে করছে। রান্নাঘরে গিয়ে নিজেই বানিয়ে নিতে পারে, কিন্তু আলসে লাগছে। ঘুম-ঘুমাও পাচ্ছে, যদিও সে জানে বিছানায় শোয়ামাত্র ঘুম পালিয়ে যাবে। তার পাশে নিশ্চিন্তে ঘুমুবে শারমিন। তার গায়ে হাত রাখলে ঘুমের ঘোরেই সে হাত সরিয়ে দিয়ে বিরক্ত গলায় বলবে— আহা! তারচে এখানে বসে-বসে মশার কামড় খাওয়াই ভালো।