সিঁড়ি দিয়ে একা একা উঠতে ভয় লাগবে ভাবী। তুমি দরজা খুলে একটু দাঁড়িয়ে থাক।
আনিস চিলেকোঠার ঘরে থাকে। খাওয়াদাওয়া করে বাড়িওয়ালা রশিদ সাহেবের বাসায়। রশিদ সাহেবের সঙ্গে তার ক্ষীণ একটি আত্মীয়তার সম্পর্ক আছে। সে সম্পর্ক মোটেই জোরালো নয়। এক সময় আশ্রয় দিয়েছিলেন। চেষ্টাচরিত্র করে সিটি কলেজে ভর্তিও করিয়েছেন। গত বৎসর আই. এ. ফেল করেছে এবং পড়াশোনা করবে না বলে জানিয়েছে। এ-রকম এক জনকে ঘরে রেখে পোষার কোনো মানে হয় না। রশিদ সাহেব এখন প্রাণপণ চেষ্টা করছেন আনিসকে ঝেড়ে ফেলতে। পারছেন না। আনিসের এ জায়গা ছেড়ে নতুন কোথাও যাবার জায়গা নেই! জোর করে তাকে বের করে দেবার মতো নিষ্ঠুরতা তিনি দেখাতে পারছেন না।
তাছাড়া ছেলে হিসেবে আনিসের বিরুদ্ধে কোনো অভিযোগ তাঁর নেই। অত্যন্ত ভদ্র ছেলে। চেহারা ভালো। আচার-ব্যবহার ভালো। চায়ের দোকান বসে বিড়ি ফোঁকে না। মেয়েদের দেখে শিস দেয় না। রশিদ সাহেবের মনে একটা গোপন পরিকল্পনা ছিল, আনিসকে পড়াশোনা করিয়ে নিজের কাছেই রেখে দেবেন। বীণার সঙ্গে বিয়ে দিয়ে দেবেন। মেয়ে—জামাই তাঁর কাছেই থাকবে।
রশিদ সাহেবের স্ত্রী সেই পরিকল্পনা একেবারেই পছন্দ করেন নি। স্বামীর নির্বুদ্ধিতায় রেগে অস্থির হয়েছেন। তাঁর মেয়ে কালো নয়, কানা-খোঁড়া নয়, তাকে হাভাতে ঘরের ছেলের সঙ্গে বিয়ে দিতে হবে? দশটা-পাঁচটা মেয়েও তার না। একটিমাত্র মেয়ে। তার বিয়ে হবে চাকর শ্রেণীর একটি ছেলের সাথে? দেশে কি ডাক্তার ইনজিনিয়ারের অভাব হয়েছে, না তাদের সহায়-সম্পদ নেই? ঢাকা শহরে তিনটি বাড়ি, গ্রামের সম্পত্তি সবই তো তাঁর মেয়েই পাবে।
আনিসের সাথে তাঁর সম্পর্ক শুরু থেকেই খারাপ ছিল। ইদানীং তিনি তাকে সহ্য করতে পারছেন না। কারণটি অত্যন্ত সূক্ষ্ম। তিনি লক্ষ করেছেন, আনিস খেতে বসলে বীণা এটা-সেটা তার পাতে তুলে দিতে চেষ্টা করে।
তিনি এক দিন বিরক্ত হয়ে বলেছিলেন, ওর খাওয়ার সময় তোর থাকার দরকার কী? তুই কেন থালাবাটি নিয়ে দৌড়াদৌড়ি করিস?
বীণা অবাক হয়ে বলেছে, একটা লোক একা একা বসে খাবে?
এক একা কোথায়? আকবরের মা আছে, রহিম আছে। তোর যাবার দরকারটা কী?
অসুবিধা কী?
অসুবিধা আছে। এতে লাই দেওয়া হয়। লাই দিলেই এরা মাথায় উঠবে। খবরদার, তুই যাবি না।
বীণা এর পরেও গিয়েছে। তিনি মনের মধ্যে একটা ভয় অনুভব করেছেন। সমন্বয়েসী দুটি ছেলেমেয়ের ঘন ঘন দেখা-সাক্ষাৎ হওয়া ঠিক না। বয়স খুব খারাপ জিনিস। একটা বয়সে সবাইকে ভালো লাগে।
আনিস ঘর অন্ধকার করে বসে ছিল। শাহানা বাইরে থেকে ভয়-পাওয়া গলায় ডাকল, আনিস ভাই?
এস শাহানা।
ঘর অন্ধকার কেন?
বাল্ব ফিউজ হয়ে গেছে।
আপনি আসুন, ভাত দেওয়া হয়েছে।
ভেতরে এস শাহানা। বাইরে দাঁড়িয়ে আছ কেন?
না, আমি ভেতরে আসব না।
কেন?
শাহানা জবাব দিল না। আনিস বের হতেই শাহানা বলল, দরজা লাগাবেন না?
অন্ধকারে তালাচাবি খুঁজে পাব না। থাকুক। চোর আমার ঘরে আসবে না। নেবার মতো কিছু নেই।
সিঁড়ি অন্ধকার। এর মধ্যে কে আবার পানি ফেলে রেখেছে। শাহানা খুব সাবধানে পা ফেলছে। একবার পিছলে পড়ার মতো হল। আনিস বলল, আমার হাত ধর শাহানা। পিছলে পড়ে হাত ভাঙবে। শাহানা কঠিন স্বরে বলল, হাত ধরতে হবে না। আমি ভালোই দেখতে পাচ্ছি। আনিস হাসল। অন্ধকারে তার হাসি দেখা গেল না।
আনিসকে খেতে বলা হয়েছে শুনে মনোয়ারা অত্যন্ত বিরক্ত হলেন। হুঁট করে কাউকে খেতে বলার অর্থটা কী? কোনো উপলক্ষ-টুপলক্ষ থাকলেও একটা কথা। হঠাৎ তার মার্জি হল, ওমনি খেতে বলা হল! দুপুর-রাতে শাহানাকে পাঠান হল ডেকে আনতে?
নীলুর এটা আজ নতুন না। আগেও বেশ কয়েক বার আনিসকে খেতে বলেছে। প্রথম বার তিনি নীলুকে তেমন কিছু বলেন নি। শুধু শুকনো গলায় বলেছেন, কাউকে দাওয়াত-টাওয়াত করতে হলে আগে আমাকে জিজ্ঞেস করবে। বুঝলে বৌমা?
নীলু বলেছে, দাওয়াত না তো। ঘরে যা রান্না হয়েছে তাই খাবে।
সেটাও আমাকে জানিও!
নীলু কোনো উত্তর দেয় নি, কিন্তু আবার খেতে বলেছে এবং তাঁকে কিছুই বলে নি। শাশুড়ির কথার অবাধ্য হবার মেয়ে নীলু না, কিন্তু এই একটি ব্যাপারে সে মনে হয়। ইচ্ছা করেই অবাধ্য হচ্ছে। মনোয়ারার মনে হল, এটা নীলুর একটা ইচ্ছাকৃত অবাধ্যতা। জানিয়ে দেওয়া যে, সেও এই সংসারের কত্রী, তারও অধিকার আছে।
মনোয়ারা গম্ভীর মুখে শফিকের ঘরে ঢুকলেন। শফিক চোখ তুলে তাকাল, কিছু বলল না।
কী করছিস?
কিছু করছি না।
ভাত খেতে দেওয়া হয়েছে, খেতে যা।
শফিক উঠে দাঁড়াল। মনোয়ারা শীতল গলায় বললেন, বৌমা দেখলাম আনিস ছোঁড়াটাকে খেতে বলেছে। তুই বৌমাকে ডেকে জিজ্ঞেস কর তো, কেন বলেছে?
এমনি বলেছে। জিজ্ঞেস করবার দরকার কী?
মনোয়ারা আরো গম্ভীর হয়ে গেলেন। শফিক বলল, ব্যাপারটা কী?
ব্যাপার কিছু না।
কিছু না তো তুমি এমন গম্ভীর হয়ে আছ কেন?
মনোয়ারা তার জবাব দিলেন না, চলে গেলেন রান্নাঘরে। নীলু ব্যস্ত হয়ে বাটিতে তরকারি ঢালছে। আয়োজন খুবই সামান্য। ছোট মাছের তরকারি, একটা সাজি ও ডাল। তরকারি মনে হয় কম পড়ে যাবে। হোসেন সাহেব দরাজ গলায় বললেন, ছোট মাছের তরকারিটা বড়ো ভালো হয়েছে। আরো নিয়ে আসা। নতুন টমেটো দিয়ে রাঁধলে যে-কোনো জিনিস ভালো হয়। নীলু পড়েছে মুশকিলে। তরকারি কিছুই নেই। মনোয়ারাকে ঢুকতে দেখে বলল, আপনিও ওদের সঙ্গে বসে পড়ুন না মা।