- বইয়ের নামঃ এইসব দিনরাত্রি
- লেখকের নামঃ হুমায়ূন আহমেদ
- প্রকাশনাঃ অনন্যা
- বিভাগসমূহঃ উপন্যাস, কল্পকাহিনী
নীলুর কেমন যেন লাগতে লাগল
সন্ধ্যার পর থেকে নীলুর কেমন যেন লাগতে লাগল। কেমন এক ধরনের অস্বস্তি। হঠাৎ ঘুম ভাঙলে যে—রকম লাগে সে-রকম। সমস্ত শরীর ঝিম ধরে আছে। মাথার ভেতরটা ফাঁকা ফাঁকা।
নীলু বারান্দায় এসে দাঁড়াল। এ বাড়ির বারান্দাটা সুন্দর। কল্যাণপুরের দিকে শহর তেমন বাড়তে শুরু করে নি। গ্রাম গ্রাম একটা ভাব আছে। বারান্দায় দাঁড়ালে ঝিলের মতো খানিকটা জায়গা চোখে পড়ে। গত শীতের আগের শীতে ঝাঁকে ঝাঁকে বুনো হাঁস নেমেছিল। কী অদ্ভুত দৃশ্য! এ বৎসর নামবে কিনা কে জানে। বোধহয় না। শহর এগিয়ে আসছে। পাখিরা শহর পছন্দ করে না।
ঠাণ্ডা বাতাস দিচ্ছে। বেশ শীত পড়েছে এবার। আজকালের মধ্যেই লেপ নামাতে হবে। নীলু, শাড়ির আঁচলে মাথা ঢেকে দূরে ঝিলের দিকে তাকিয়ে রইল।
বসার ঘরে তার ননদ চেঁচিয়ে চেঁচিয়ে পড়ছে। কখগ ও চ্ছজ দুইটি সমকোণী ত্রিভুজ। ইহাদের কখ ও চ্ছ বাহু দুইটি সমান। প্রমাণ করা যে। মিষ্টি গলা শাহানার। পড়াটা শুনতেও গানের মতো লাগছে। আজ কি ওর প্রাইভেট মাস্টারের আসার তারিখ? আজ বুধবার না মঙ্গলবার? নীলু মনে করতে পারল না। ভদ্রলোক বুধবারে আসেন। নীলু মনে মনে প্রার্থনা করতে লাগল যেন আজ বুধবার না হয়।
বুধবার হলেই ভদ্রলোক আসবেন। এবং নীলুকে সারাক্ষণ তাদের আশেপাশে বসে থাকতে হবে। নজর রাখতে হবে। কারণ শাহানা গত সপ্তাহে চোখ-মুখ লাল করে তাকে বলেছে, ভাবী, এই স্যারের কাছে আমি পড়ব না।
নীলু অবাক হয়ে বলেছে, কেন?
স্যারটা ভালো না ভাবী। চেয়ারের নিচে পা দিয়ে সারাক্ষণ আমার পা ছুঁতে চায়।
কী যে বল! হঠাৎ হয়তো লেগে গেছে।
না ভাবী, হঠাৎ না। আমি যতই পা সরিয়ে নিই, সে ততই নিজের পা এগিয়ে দেয়।
নীলু আর কিছু বলে নি। কিন্তু বললেই তো আর মাস্টার বদলানো যায় না। এত কম টাকায় পাওয়াও যাবে না। কাউকে। মাস্টার ছাড়া চলবেও না। প্রিটেস্টে শাহানা অঙ্কে পেয়েছে এগারো। তাদের বড়ো আপা গম্ভীর হয়ে জানিয়ে দিয়েছেন, শাহানাকে যেন ইলেকটিভ অঙ্কে কোচ করানো হয়। প্রাইভেট মাস্টার জোগাড় করতে হয়েছে বহু ঝামেলা করে। কিন্তু বুড়োমতো এই ভদ্রলোকের এ কী কাণ্ড। অথচ ভালোমানুষের মতো চেহার। পড়ায়ও ভালো। কত ধরনের মানুষ থাকে সংসারে!
নীলু। ছোট একটা নিঃশ্বাস ফেলল। বারান্দায় দাঁড়িয়ে থাকতে তালো লাগছে না। আবার ভেতরে যেতেও ইচ্ছা করছে না। কেন জানি ইচ্ছা হচ্ছে চৈচিয়ে কাঁদতে। এ-রকম তার কখনো হয় না। নীলুর একটু ভয়-ভয় করতে व्लोव्।
বাড়িতে সে এবং শাহানা ছাড়া দ্বিতীয় প্রাণী নেই। সবাই খিলগাঁয়ে এক বিয়ের দাওয়াতে গেছে। রাত এগারটার আগে ফিরবে না। কিংবা কে জানে হয়তো আরো রাত হবে। বারোটা–একটা বাজবে।
শাহানা ভেতর থেকে ডাকল, ভাবী, একটু শুনে যাও তো? নীলু। ভেতরে ঢুকল।
জানালায় কে যেন খটখট করছে ভাবী। আমার ভয়-ভয় লাগছে। তুমি এখানে বসে থাক।
নীলু বসল তার পাশে। শাহানা বলল, তোমাকে এ-রকম দেখাচ্ছে কেন ভাবী?
কি রকম দেখাচ্ছে?
মুখটা কি রকম কালো কালো লাগছে।
কালো মানুষ, কালো কালো তো লাগবেই।
শাহানা একদৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল। ভাবীর দিকে। ভাবী কালো ঠিকই কিন্তু তার মধ্যে অদ্ভুত একটা স্নিগ্ধতা আছে। আর এত সুন্দর ভাবীর চোখ! শুধু তাকিয়ে থাকতে ইচ্ছা করে।
এ-রকম তাকিয়ে আছ কেন শাহানা?
শাহানা লজ্জা পেয়ে চোখ নামিয়ে নিল। নীলু বলল, আজ কী বার, মঙ্গলবার না বুধবার?
মঙ্গলবার।
তোমার স্যার আজ আসবে না তো?
না।
শাহানা ইতস্তত করে বলল, স্যারের কথাটা তুমি কাউকে বল নি তো ভাবী?
না।
কাউকে বলবে না। বড়ো লজ্জার ব্যাপার। তুমি ভাবী ভদ্রলোককে নিষেধ করে দাও। প্ৰাইভেট মাস্টার আমার লাগবে না।
নীলু কিছু বলল না। আড়চোখে দেখল, শাহানার ফর্সা গাল লাল হয়ে আছে। এই মেয়েটা বড়ো সহজেই লজ্জা পায়। তার এ জন্যে লজ্জা পাবার কী আছে?
নীলু উঠে দাঁড়াল। শাহানা বলল, যাচ্ছ কোথায় ভাবী?
যাচ্ছি না। সোফায় একটু শোব। শরীরটা ভালো লাগছে না। শাহানা।
কি হয়েছে?
বুঝতে পারছিনা।
শাহানা তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল। তারও কেমন ভয়-ভয় করতে লাগল–সে-সব কিছু না তো? তিন বছর আগে একদিন বিকেলবেলা ভাবী তার চুল বেণী করে দিচ্ছিল। হঠাৎ ক্লান্ত স্বরে বলল, শাহানা, মাকে একটু ডাক তো, শরীরটা কেমন যেন করছে।
দেখতে দেখতে নেতিয়ে পড়ল সে। কী কাণ্ড, কী ছোটাছুটি। পেটে তিন মাসের বাচ্চা! ডাক্তার এসে বললেন, এ্যাবোরশন হয়ে গেছে। হাসপাতালে ভর্তি করাতে হবে। পনের দিন হাসপাতালে থেকে কাঠির মতো হয়ে সে ফিরে এল।
ডাক্তার ভয় ধরিয়ে দিলেন। বলে দিলেন খুব সাবধানে থাকতে হবে। এ্যাবোরশন হবার একটা স্বাভাবিক টেণ্ডেন্সি তার আছে। কিছু কিছু মেয়ের থাকে এ-রকম।
শাহানা লক্ষ করল, নীলু। খুব ঘামছে। সে-রকম কিছু না তো? সে ভয়ে ভয়ে ডাকল, ভাবী! নীলুতাকল, কিছু বলল না।
ভাবী, সে-রকম কিছু না তো?
না বোধহয়। ডাক্তার বলেছিল, সাত মাস পার হলে ভয় নেই।
তোমার এখন কতদিন? আট মাস না?
হুঁ।
পানি খাবে ভাবী?
না।
ভাবী, বাড়িওয়ালাদের বাসায় গিয়ে কাউকে ডেকে আনব?
না। কাউকে ডাকতে হবে না।
শাহানা একটা বালিশ এবং চাদর এনে দিল। মৃদুস্বরে বলল, সোফার উপরই শুয়ে থাক। চুল টেনে দেব?