দবির মিয়া অবশ্য ভদ্ৰভাবেই ওদের সঙ্গে কথাবার্তা বলল। ছেলের চাচার পাতে প্রবল আপত্তি সত্তেও দুটি সন্দেশ তুলে দিল। আয়োজন ছিল প্রচুর, তবু বেশ কয়েক বার বলল, যোগ্য সমাদর করতে পারলাম না। আমি খুবই শরমিন্দা ইত্যাদি। মেয়ের গান গাওয়ার সময় যখন এল তখন সে ঘর থেকে বেরিয়ে এল। এইসব ছেলে-ছোকরার ব্যাপারে সে থাকতে চায় না। দবির মিয়া বারান্দায় এসে দেখে জহুর এসেছে। মোড়ায় বসে চা খাচ্ছে এক-একা।
জহুর, কোথায় ছিলে?
একটু বাইরে গিয়েছিলাম দুলাভাই।
লোকজন আসছে, ঘরে থাকলেই পারতে।
জহুর স্বাভাবিক স্বরেই বলল, দুলাভাই, আমি থাকলে নানা রকম জিজ্ঞাসাবাদ হবে। সেটা বিয়েটিয়ের জন্যে ভালো না।
দবির মিয়া চুপ করে গেল। জহুর বলল, যে বাড়িতে এক জন খুনী আসামী থাকে, সে বাড়ির মেয়ে বউ হিসেবে নিতে ভয়-ভয় লাগবে।
বলতে-বলতে জহুর মৃদু হাসল, আর ঠিক তখনি টুনীর গান শোনা গেল, আমি বন ফুল গো……। দবির মিয়া ঢোক গিলল। জহুর অবাক হয়ে বলল, টুনী গাইছে নাকি?
হুঁ?
গান শিখল কবে?
দবির মিয়া উত্তর দিল না। জহুর বলল, দুলাভাই, টুনী এত সুন্দর গান গায়। কী আশ্চর্য। আমি তো……
দবির মিয়া মিনমিন করে কী বলল ঠিক বোঝা গেল না। গান শেষে সাইফুল ইসলামের কথা শোনা গেল, মারাত্মক গলা। নিজের ছাত্রী বলে বলছিনা। হেঁ-হেঁ-হেঁ। খুব টনটনে গলা। খুব ধার।
ওরা মেয়ে পছন্দ করে গেল। মোটামুটিভাবে স্থির হল শ্রাবণ মাসে বিয়ে হবে। দেনা-পাওনা তেমন কিছু না। মেয়ের বাবা ইচ্ছে করে কিছু দিলে দেবেন–সেটা তাঁর মেয়েরই থাকবে। তবে ছেলের একটা মোটর সাইকেলের সখ। হোণ্ডা ফিফটি সিসি। তারা যাবার আগে টুনীকে ময়লা তেল চিটচিটে একটা এক শ টাকার নোট দিয়ে গেল।
দবির মিয়ার খুশি হওয়ার কথা, কিন্তু সে মনমরা হয়ে রইল। তার ওপর অনুফ যখন বলল, তার ছেলে পছন্দ হয় নি, তখন সে বেশ রেগে গেল। মেয়েছেলেরা ঝামেলা বাধার ওস্তাদ। পছন্দ না-হওয়ার আছে কী? ছেলের জমিজমা আছে। টুকটাক বিজনেস আছে। প্রাইমারি স্কুলের মাষ্টার, অসুবিধাটা কোথায়?
অনুফা মিনমিন করে বলল, ছেলেটা বেহায়া।
বেহায়া? বেহায়ার কী দেখলে? মেয়েমানুষ তো না যে ঘোমটা দিয়ে থাকবে।
অনুফা ঢক গিলে বলল, টুনীর পছন্দ হয় নাই।
টুনীর আবার পছন্দ-অপছন্দ কি? শুধু ফালতু বাত। একদম চুপ।
টুনী কানতাছে।
কান্দুক। তুই চুপ থাক।
তুইতকারি কর কেন?
বললাম চুপ।
দবির মিয়া দোকানে গেল মুখ কালো করে। যাবার পথে এক বার থানায় যাবে, এরকম পরিকল্পনা ছিল। মনসুরের ব্যাপারে কী হল জানা দরকার। কিন্তু থানায় যেতে আর ইচ্ছা করল না। যা ইচ্ছা করুক। মেরে তক্তা বানিয়ে দিক।
জুম্মাঘরের পাশ দিয়ে যাবার সময় চৌধুরী সাহেবের সঙ্গে দেখা হয়ে গেল। চৌধুরী সাহেব যেন দেখেও দেখলেন না। এর মানেটা কী? দবির মিয়া বলল, চৌধুরী সাহেব না? মালিকুম।
ও, তুমি। এত রাইতে কী কর?
রাত বেশি হয় নাই চৌধুরী সাব। দোকানের দিকে যাই।
চৌধুরী সাহেব দাঁড়িয়ে পড়লেন।
তোমার সঙ্গে কথা আছে দবির।
কী কথা, বলেন।
রাস্তার মধ্যে তো কথা হয় না। এক দিন বাড়িতে আস।
এখন যাব? এখন অবসর আছি।
না, এখন না।
কালকে আসব? সকালে?
দিন-তারিখ করবার দরকার নাই। অবসর মতো এক বার আস।
দবির মিয়া অত্যন্ত চিন্তিত মুখে বাড়ি ফিরে গেল।
সাইফুল ইসলাম খানার পাশ দিয়ে
সাইফুল ইসলাম খানার পাশ দিয়ে বাজারে যাচ্ছিল। নান্টুর দোকানে সে এখন যাবে। একটা চা এবং নিমকি খাবে। মাসকাবারি ব্যবস্থা করা আছে। মাসের শেষে টাকা দিতে হয়। এ ছাড়াও নান্টু লোকটি গান-বাজনার সমজদার। চা খেতেখেতে তার সঙ্গে গান-বাজনা নিয়ে দু-একটা টুকটাক কথা হয়। সাইফুল ইসলামের বড় ভালো লাগে। এই অঞ্চলে গান-বাজনার কোনো কদর নেই। মূখের দেশ।
সাইফুল ইসলাম শব্দ করে করে পা ফেলছিল। তার খুব সাপের ভয়। রাতের বেলা হাঁটাচলা করবার সময় সে সাড়াশব্দ করে হাঁটে। আজও সে গুনগুন করছিল,–আসে বসন্ত ফুল বনে। কিন্তু হঠাৎ সে গান থামিয়ে পাথরের মূর্তির মতো জমে গেল। বিকট চিঙ্কার আসছে থানা থেকে। বিকট এবং বীভৎস। যেন কেউ লোটার একটা হাত টেনে ছিড়ে ফেলেছে। কিংবা একটা চোখ উপড়ে ফেলেছে।
বসন্তকালে রাতের ঠাণ্ডা হাওয়ার মধ্যেও সে কুলকুল করে ঘামতে লাগল। সাপের কথা আর তার মনে রইল না। টর্চ নিভিয়ে সে নিঃশব্দে বাজারের দিকে রওনা হল।
নান্টু মিয়া তার দোকান খোলৈ নি। তার জলবসন্ত হয়েছে। সাইফুল ইসলাম নার দোকানের সামনে অনেকক্ষণ দাঁড়িয়ে থেকে নিজের ঘরের দিকে রওনা হল। নার দোকান ছাড়া অন্য কোন দোকানে সে চা খায় না। নান্টুর দোকানে সে নিজের পয়সায় একটা কাপ কিনে রেখেছে। এই কাপে নান্টু অন্য কাউকে চা দেয় না।
জহুরের বিছানা আজ বারান্দায়
জহুরের বিছানা আজ বারান্দায় পাতা হয়েছে। টুনী মশারি খাটাতে এসে নরম গলায় বলল, বৃষ্টি হলে কিন্তু ভিজে যাবে মামা। বৃষ্টি হবে আজ রাতে। জহুরের মনে হল টুনীর চোখ ভেজাভেজা।
জহুর নিচু গলায় বলল, তুই তো ভালো গান শিখেছিস।
টুনী চুপ করে রইল। মশারি খাটাতে তার বেশ ঝামেলা হচ্ছে। দড়ি-বাঁধবার জায়গা পাওয়া যাচ্ছে না। জহুর বলল, মশারি পরে খাটাবি, বস তুই। তোর সঙ্গে তো আমার কথাই হয় না।
রান্না হয় নাই, মামা।
রান্নাবান্না সব সময় তুই করিস নাকি?
মাঝে মাঝে অজু করে। অঞ্জুর রান্না বাবা খেতে পারে না।