জ্বি।
একাই করেছি, না আরো লোক ছিল?
ছিল। কে কে ছিল?
জ্বি ছিল।
হারামজাদা, ছিল কে?
জ্বি?
তোর সাথে আর কে ছিল?
কয় জন ছিল?
স্যার স্মরণ নাই।
আচ্ছা, অরণের ব্যবস্থা করি, দেখ।
সন্ধ্যাবেলায় দবির মিয়া এসে দেখল থানা হাজতে এক কোণায় কুণ্ডলী পাকিয়ে সে শুয়ে আছে। দবির মিয়া ডাকল, এ্যাই মনসুর, এ্যাই।
মনসুর শূন্য দৃষ্টিতে তাকাল, কিছু বলল না।
মনসুর ভয় নাই, তরে নিতে আইছি, উইঠা দাঁড়া।
মনসুর উঠে দাঁড়াল না।
হাজতের জন্য প্রান্তে লম্বা দাড়িওয়ালা যে-লোকটা দেয়ালে ঠেস দিয়ে বসেছিল সে বলল, এই শালার পুতে কাপড়চোপড় নষ্ট কইরা দিছে, গন্ধে থাকন দায়।
দবির মিয়াও তখন একটি তীব্র কটু গন্ধ পেল। ওসি সাহেব এলেন রাত নটায়। দবির মিয়া মনসুরকে ছাড়িয়ে নিতে এসছে শুনে তিনি গম্ভীর হয়ে পড়লেন।
ডেফিনিট চার্জ আছে, ওকে ছাড়াবেন কি?
কী চার্জ আছে?
চুরির, আর কিসের? শক্ত প্যাদানি দিলে আগের চুরিগুলোরও খোঁজ পাওয়া যাবে, বুঝলেন?
আগেরগুলোও তার করা নাকি? কী যে বলেন ওসি সাহেব বোকাসোকা মানুষ।
আরে রাখেন রাখেন। ধোলাই দিলেই দেখবেন নাম-ধাম বের হয়ে যাবে। খোলাইয়ের মতো জিনিস আছে?
দবির মিয়া ফিরে আসার সময় দারোগা সাহেব অপ্রাসঙ্গিকভাবে বললেন, শুনলাম আপনার ভাই ছাড়া পেয়েছে।
ভাই না। ছোট শ্যালক।
একই কথা। সে আপনার সঙ্গেই থাকবে?
জ্বি।
ভালো। খেয়ালটেয়াল রাখবেন। জেলখানা জায়গাটা খারাপ। অসৎসঙ্গ। এক বার জেলে গেলে অনেক রকম ফন্দি-ফিকির লোকজন শেখে। বুঝলেন?
দবির মিয়া কিছু বলল না। দারোগা সাহেব একটা দেশলাইয়ের কাঠি দিয়ে কানের ময়লা আনতে আনতে প্রসঙ্গ শেষ করলেন, খেয়ালটেয়াল রাখবেন, বুঝলেন। দিনকাল খারাপ।
মনসুরের ব্যাপারটা কী করবেন?
দেখি।
বেচারা নির্দোষ।
দেখি।
দবির মিয়া অত্যন্ত মনমরা হয়ে দোকানে ফিরে এল। দোকান খোলার পরপর আর একটি খারাপ খবর পেল। ডালের দাম পড়ে গেছে, সরসটা দু শ তিন টাকা দরে বিকোচ্ছে। চৌধুরী সাহেব সত্তর মন ডাল কিনে রেখেছেন। সেগুলো নাকি ছেড়ে দেবেন, এরকম গুজব। চৌধুরী সাহেবের সঙ্গে কথা বলা দরকার।
চৌধুরী সাহেব বাজারের মসজিদে এশার নামাজ পড়তে আসেন। কিন্তু নামাজ রাত আটটায় শেষ হয়ে গেছে। আগে আসতে পারলে হত। দবির মিয়া তবু মসজিদের সামনে দিয়ে এক পাক হাঁটল।
মসজিদে ওয়াজ হচ্ছে। মৌলভী আবু নসর সাহেব টেনে টেনে বলছেন, এই দুনিয়াদারী অল্পদিনের। হাশরের ময়দানে আল্লাহ্ পাক সব মুর্দা জিলা করে তুলবেন। ভাইসব, কারো গায়ে একটা সূতা পর্যন্ত থাকবে না। পুরুষ এবং স্ত্রী উলঙ্গ অবস্থায় উঠে আসবে ভাইসব। কিন্তু কেউ কারো লজ্জাস্থান দেখবে না। তখন সূর্য থাকবে আধ হাত মাথার উপর। ভাইসব জিনিসটা খেয়াল রাখবেন…
সন্ধ্যার আগেই বাঁয়া-তবলা নিয়ে
সাইফুল ইসলাম সন্ধ্যার আগেই বাঁয়া-তবলা নিয়ে দবির মিয়ার বাড়ি উপস্থিত হল। তার কিছুক্ষণ পর ন-দশ বছরের একটা ছেলে মাথায় একটা সিঙ্গেল রীড হারমোনিয়াম নিয়ে ঘামতে ঘামতে এসে উপস্থিত। দবির মিয়া দুজনের কাউকে। কিছু বলল না। অতিরিক্ত গম্ভীর মুখ করে সে বসে রইল।
আজ টুনীকে দেখতে আসবে। বরপক্ষের কেউ যদি গান শুনতে চায়, সেজন্যই এ-ব্যবস্থা। দবির মিয়া কাল রাতেই জানতে পেরেছে টুনী বনের তাপস কুমারী আমি গো এই গানটি হারমোনিয়াম বাজিয়ে নিজে নিজে গাইতে পারে। শোনার পর থেকেই সে গম্ভীর হয়ে আছে। সিও সাহেবের মেয়ের সঙ্গে লুকিয়ে লুকিয়ে গান শেখার মানেটা কি? এত যদি গানের সখ, তাকে বললেই হত। অবশ্য বললেই যে সে গান শেখার ব্যবস্থা করত, তা নয়। নিতান্তই বাজে খরচ। হারমোনিয়াম সামনে নিয়ে মুখ বাঁকা করে চ্যাঁচ করার কোন মানে হয়? তাছাড়া শরিয়তেও গান-বাজনা নিষেধ আছে। কঠিন নিষেধ।
দবির মিয়া মুখ গম্ভীর করে থাকলেও আজকে গানের ব্যাপারে কোনো আপত্তি করে নি। এই মেয়েটি পার করা মুশকিল হয়ে যাচ্ছে। ইদানীং নতুন একটা টং হয়েছে, মেয়ে দেখতে এসে গম্ভীর মুখে জিজ্ঞেস করা, তা গানটান কিছু জানে নাকি?
কি আমার গানের সমঝদার একেক জন। বিয়ের পরপরই ঢুকিয়ে দেবে রান্নাঘরে অথচ কথাবার্তা এ-রকম–যেন মিয়া তানসেন।
সাইফুল ইসলাম বলল, ইনারা দেরি করবেন নাকি?
দবির মিয়া জবাব দিল না। সাইফুল ইসলাম মুখে পাউডার মেখে এসেছে। সেন্ট-দেওয়া রুমাল দিয়ে ঘন ঘন নাক ঘষছে। মাগীমার্কা এই অপদার্থটাকে সহ্য করা মুশকিল। দেখলেই মনে হয় এই হারামজাদা গান শেখাবার ছলে সুযোগ পেলেই মেয়েছেলের গায়ে হাত দেয়।
দবির মিয়া লক্ষ করল অঞ্জু যত বার বাইরে আসছে, তত বারই এই শালা সাইফুল ইসলাম চোখ ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে তাকাচ্ছে। এক বার আবার বলল, এই খুকি, এক গ্রাস জল খাওয়াবে? জল খাওয়াবে কিরে হারামজাদা? পানি আবার জল হল কবে থেকে? দুই ঢোক পানি গিলেই চিকন স্বরে বলল, ধন্যবাদ। দবির মিয়া বহু কষ্টে রাগ সামলে মাগরেবের নামাজ পড়তে গেল।
বরপক্ষের লোকজন এসে পড়ল নামাজের মাঝামাঝি সময়ে। দবির মিয়া ইচ্ছা করে নামাজে দেরি করতে লাগল। মেয়ের বাপ ধৰ্মভীরু হলে দেখায় ভালো।
মেয়ে দেখতে এসেছে চার জন। মুরব্বি হল ছেলের চাচা, নেত্রকোণার সাবরেজিস্ট্রি অফিসে চাকরি করেন। ছেলে নিজেও এসেছে, সঙ্গে তার দু জন বন্ধু। ছেলে অতিরিক্ত লম্বা। মুখে বসন্তের দাগ। ধূর্ত চোখ। আসার পর থেকেই শেয়ালের মতো এদিক-ওদিক তাকাচ্ছে। কপালের কাছে বিরাট একটা আছিল–সেখান থেকে তিন-চারটা লম্বা কালো চুল ভুরু পর্যন্ত চলে এসেছে। অথচ প্রস্তাব যে এনেছে সে বলেছিল, রাজপুত্রের মতো গায়ের রঙ, খুব আদব লেহাজ। দবির মিয়া আদব-লেহাজের কিছুই দেখল না। আধা ঘন্টাও হয় নি এসেছে, এর মধ্যে বন্ধুদের নিয়ে তিন বার বারান্দায় গিয়ে সিগারেট টেনে এসেছে। অঙ্কুকে দেখে গলা খাকারি দিয়েছে। চড় দিয়ে এই হারামজাদার বিয়ের ইচ্ছা ঘুচিয়ে দিতে হয়।