জহুর হালকা গলায় বলল, দুলাভাইয়ের অনেক টাকা হয়েছে নাকি রে?
হুঁ।
ঘর-দুয়ার তো কিছু ঠিকঠাক করে নাই।
বাবা টাকা খরচ করে না।
তাই নাকি?
হুঁ। সবাই বলছিল বড়োপাকে দুই-একটা গানটান শেখাতে। তাহলে চট করে বিয়ে হবে। তা বাবা শেখাবে না। হারমোনিয়াম কিনতে হবে যে!
এখন বিয়ে হবার জন্যে গান শিখতে হয়?
হুঁ, হয়। যাদের গায়ের রঙ কালো তাদের হয়।
এখানে গান শেখায় কে?
কে আবার, বগা ভাই।
বগা ভাইটা কে?
তুমি চিনবে না, সাইফুল ইসলাম। বকের মত হাঁটে, তাই নাম বগা ভাই।
অঞ্জু মুখ নিচু করে হাসল। পরমুহূর্তেই হাসি থামিয়ে গম্ভীর হয়ে বলল, অনেকে আবার ডাকে জেলি ফিশ। খুব মজার লোক মামা।
জহুর কিছু বলল না। বাবলু এবং বাহাদুরের কান্ন শোনা যেতে লাগল। দবির মিয়ার গর্জনও ভেসে এল, খুন করে ফেলব। আজকে আমি দুটাকেই জানে শেষ করে দেব।
জহুর বলল, ব্যাপার কি অঞ্জু?
ওরা আজ আবার বিছানা ভিজিয়ে ফেলেছে।
দবির মিয়ার রাগ ক্রমেই চড়ছে : হারামজাদাদের আজ আমি বাপের নাম ভুলিয়ে দেব। ধামড়া ধামড়া একটা, আর কাণ্ডটা দেখ।
জহুর বলল, আমি একটু ঘুরে আসি অঞ্জু।
কোথায় যাও?
এই এনি একটু হাঁটব।
নাস্তা খেয়ে যাও।
এসে পড়ব, বেশি দেরি হবে না।
ছোট চৌধুরী নিমের ডাল দিয়ে দাঁত মাজছিলেন। দাঁত মাজার পর্বটি তাঁর দীর্ঘ। বাড়ির সামনে হাঁটাহাঁটি করেন এবং দাঁত মাজেন। তাঁর পরনে একটি লুঙ্গি এবং পাঞ্জাবি। পাঞ্জাবির বোম সবগুলো খোলা। মুখ থেকে কম পড়ে পাঞ্জাবির জায়গায় জায়গায় ভিজে উঠেছে। তিনি এটা তেমন গ্রাহ্য করছেন না। কারণ দাঁত মাজা শেষ হলেই তিনি গোসল করেন। গোসলের পানি গরম হচ্ছে।
বাড়ির সামনের রাস্তা দিয়ে যে-ই হেঁটে যাচ্ছে, তাকেই তিনি দু-একটা ছোটখাটো প্রশ্ন করছেন, কে, জলিল না? আছ কেমন? বড়োছেলের চিঠিপত্র পাও? মনু মিয়া, তোমার বাতের ব্যথা কি কমতির দিকে? এ্যাঁ, আরো বাড়ছে? বল কি!
আজকের রুটিন অন্য রকম হল। তিনি দেখলেন, জহুর আলি হনহন করে আসছে। জহুর আলিকে দেখতে পেয়ে তিনি তেমন অবাক হলেন না। সে যে ছাড়া পেয়েছে এবং এখানে এসে পৌছেছে সে খবর তাঁর জানা। কিন্তু তার হনহন করে হাঁটার ভঙ্গিটা চোখে লাগে। কোনো উদ্দেশ্য ছাড়া কেউ এ রকম হাঁটে না। কিন্তু এই সকালবেলা তার কী উদ্দেশ্য থাকতে পারে?
চৌধুরী সাহেব ভালো আছেন?
চৌধুরী সাহেব চট করে জবাব দিতে পারলেন না। কিছুক্ষণ সময় লাগল।
জহুর না?
হ্যাঁ।
ছাড়া পেয়েছ নাকি?
হ্যাঁ, ছাড়া পেয়েছি।
ভালো, ভালো। খুব ভালো।
ছোট চৌধুরী লক্ষ করলেন জহুর আলি যেন হাসছে। নাকি চোখের ভুল? ইদানীং তিনি চোখে ভালো দেখতে পান না।
জহুর, বসবে নাকি?
নাহ।
জহুর না বলেই গেট ধরে দাঁড়িয়ে রইল। এর মানে কী? কী বোঝাতে চায় সে?
নীলগঞ্জের অনেক পরিবর্তন হয়েছে, কি বল জহুর?
জহুর তার উত্তরে থেমে থেমে বলল, চৌধুরী সাহেব, কিছু-কিছু জিনিসের কোনো পরিবর্তন হয় না।
বলতে চাও কী তুমি?
না, কিছু বলতে চাই না।
জহুর আলি লোহার গেটে ভর দিয়ে দাঁড়াল। চৌধুরী সাহেবের গোসলের পানি। গরম হয়েছে খবর আসতেই তিনি ভেতরে চলে গেলেন। জহুর গেটে হেলান দিয়ে তবু দাঁড়িয়ে রইল। চৌধুরী সাহেবের পানি গরম হবার খবর যে দিতে এসেছিল সে বলল, কিছু চান মিয়াভাই?
জহুর বলল, কিছু চাই না।
অমাবস্যার রাতে নীলগঞ্জ বাজারে
অমাবস্যার রাতে নীলগঞ্জ বাজারে চুরি হবে, এটা জানা কথা। থানাওয়ালা সে জন্যেই অমাবস্যার রাতে নীলগঞ্জ বাজারে একজন পুলিশ রাখে। তবু চুরি হয়। বাজার সমিতির দারোয়ানের নাকের ডগায় চুরি হয়। দবির মিয়া অতিরিক্ত সাবধানী। সে বাজার সমিতির দারোয়ানের ওপর ভরসা না করে এক জন লোক রেখেছে, যে রাতে দোকানের ঝাঁপ ফেলে সজাগ ঘুম ঘুমায়। কিন্তু শেষরক্ষা হয় নি। গত রাতে দবির মিয়ার দোকানে চুরি হয়েছে। ক্যাশবাক্সের কোনো টাকা নিতে পারে নি, কারণ সেখানে কোনো টাকা ছিল না। দুই থান ছিটের কাপড়, দশ গজ লংক্ৰথ। এবং পপলিনের কাটা পিসগুলো নিয়ে গেছে। ক্যাশবাক্সের পাশে গাদা করা ছিল নীল এবং সাদা রঙের মশারি। সবগুলো কাঁচি দিয়ে কুচি কুচি করে কেটেছে।
দবির মিয়া দোকানে এসে কেঁদে ফেলল। ছাপ্পান্নটা নতুন মশারি পরশু দিন ময়মনসিংহ থেকে এসেছে। নাইটগার্ডকে দেখা গেল পান খেয়ে মুখ লাল করে ঘুরে বেড়াচ্ছে এবং যে-ই আসছে তাকেই মহা উৎসাহে ক্ষয়ক্ষতির বিবরণ দিচ্ছে, ছাপ্পান্নটা মশারি, নটা শাড়ি, পনেরটা লুঙ্গি আর আপনের কাপড়ের থান সব মিলাইয়া…….
দবির মিয়া প্রচণ্ড একটা চড় কষিয়ে দিল নাইটগার্ডের গালে। পুলিশ এল বেলা বারটার দিকে।
দবির মিয়া তখন দোকানে ছিল না। পুলিশ খানিক জিজ্ঞাসাবাদ করে নাইটগার্ডের কোমরে দড়ি বেঁধে থানায় নিয়ে গেল। নাইটগার্ডটির বিস্ময়ের সীমা রইল না। এমন একটা কিছু হতে পারে, তা তার ধারণার বাইরে ছিল। সে রাস্তায় যার সঙ্গে দেখা হল তাকেই ভাঙা গলায় বলতে লাগল, দবির চাচাজীরে এটু খবর দেন। আপনের পাওডাও ধরি।
বিকেলের মধ্যে নাইটগার্ড আধমরা হয়ে গেল। রুলের বাড়ি খেয়ে তার নিচের পার্টির একটি দাঁত নড়ে গেল। স্বীকারোক্তি আদায়ের জন্যে এক পর্যায়ে তার অণ্ডকোষ চেপে ধরায় সে তীব্র ব্যথায় বমি করে ফেলল এবং ক্ষীণ স্বরে অর্থহীন কথাবার্তা বলতে লাগল। জমাদার সাহেব বললেন, কি, চুরি করেছিল?