থানায় গিয়ে দবির মিয়া আকাশ থেকে পড়ল। জহুর আলিকে শম্ভুগঞ্জে খুনের দায়ে গ্রেফতার করা হয়েছে। খুন হয়েছে বদি। ব্যাপারটি এমনই অবিশ্বাস্য যে দবির মিয়া ঘটনার উপর তেমন গুরুত্ব দিল না। ভুল হয়েছে বলাই বাহুল্য। কিন্তু সমস্তটাই অল্প সময়ের মধ্যে জট পাকিয়ে গেল। তাজ বোর্ডিংয়ের মালিক বলল, জহরকে সে ৯ নম্বর ঘর থেকে বের হতে দেখেছে, তার শার্ট রক্তমাখা ছিল। এবং সে তাজ বোর্ডংয়ের মালিককে দেখে ঘুট করে সরে পড়ে। কী সর্বনাশের কথা!
দবির মিয়া শম্ভুগঞ্জ থানা হাজতে দেখা করতে গেল। উকিল-টুকিল দিতে হয়, শতেক ঝামেলা। জহুরকে খুব বিচলিত মনে হল না। সে বেশ স্বাভাবিকভাবে বলল, মিথ্যা মামলা দুলাভাই। হোট চৌধুরীর কারবার। কিছু হবে না। বদি ভাইকে আমি খুন করব কেন?
তুই তার হোটলে গেছিলি কি জন্য?
গল্প করবার জন্যে গেছিলাম।
দবির মিয়া কপালের ঘাম মুছে ক্লান্ত স্বরে বলল, এখন আমি করি কি?
কিছু করতে হবে না, বসে থাকেন চুপচাপ। বড়োআপা কেমন আছে?
দবির মিয়া তার জবাব না দিয়ে ভোঁ ভেউ করে কেঁদে ফেলল।
যান, ঘোট চৌধুরীর সঙ্গে দেখা করেন। কাঁদবার তো কিছু হয় নাই।
কাঁদবার কিছু হয় নাই, বলিস কি তুই! আমার কি টাকাপয়সা আছে?
টাকাপয়সার কী দরকার? টাকাপয়সা ছাড়া মামলা-মোকদ্দমা হয়?
দুলাভাই, আপনি চৌধুরী সাহেবের কাছে যান।
ছোট চৌধুরী দবির মিয়ার উপর দারুণ রেগে গেলেন।
খুন হয়েছে বলি, ধরেছে তোমার শালাকে, আমি এর মধ্যে কে? তোমার শালার মাথা আধা-খারাপ আমরা জানি, তোমারটাও যে খারাপ, তা তো জানতাম না।
দবির মিয়া আমতা-আমতা করতে লাগল।
যাও, ভালোমতত উকিল-টুকিল দেও। পয়সাপাতি খরচ কর। অপরাধ একটা করে ফেলেছে, কী আর করা। চেষ্টাটা তোকরাই লাগে।
খুন সে করে নাই চৌধুরী সাহেব।
তুমি আমি বললে তো হবে না–দেখবে কোর্ট।
দবির মিয়া দীর্ঘ সময় চুপচাপ থেকে বলল, জহুরের মাথাটা গরম, আপনার সঙ্গে বেয়াদপি করেছে অনেক বার……
কথার মাঝখানে তাকে থামিয়ে দিয়ে চৌধুরী সাহেব রাগী গলায় বললেন, এই জন্যে আমি তারে খুনের আসামী দিয়ে দিলাম? অন্য কেউ এই কথা বললে আমি তারে জুপিটা করতাম। নেহায়েত দুঃখে-ধান্ধায় তোমার মাথার ঠিক নাই, তাই কিছু বললাম না।
দবির মিয়া বাসায় ফিরে দেখে তার স্ত্রীর এবরশন হয়েছে। এখন-তখন অবস্থা। দুপুররাতে তাকে নিয়ে ময়মনসিংহ সদর হাসপাতালে যাবার জন্যে ট্রেনে উঠতে হল। কপাল খারাপ থাকলে যা হয়। যে ট্রেনের চার ঘন্টার মধ্যে ময়মনসিংহ পৌছার কথা, সেটা পৌছল ন ঘন্টা পর। ময়মনসিংহ স্টেশনে মরা লাশ নিয়ে দবির মিয়া গলা ফাটিয়ে কাঁদতে লাগল। তার চারপাশে লোক জমে গেল।
অঞ্জু খুব ভোরে ঘুম থেকে ওঠে
অঞ্জু খুব ভোরে ঘুম থেকে ওঠে। যত রাতেই ঘুমাতে যাক সূর্য ওঠার আগে তার ঘুম ভাঙবেই। এত ভোরে আর কেউ ওঠে না। অঞ্জু তাই একা-একা বারান্দার বেঞ্চিটায় বসে থাকে। অবশ্যি গত কয়েক মাস ধরে তাকে একা-একা বেঞ্চিতে বসে থাকতে হচ্ছে না। অঞ্জু পাশের বাড়ি থেকে চেয়ে তিনটি গোলাপের কলম এনেছে। কলম তিনটি বহু যতে লাগান হয়েছে বাড়ির পেছনের ফাঁকা জায়গায়। অঞ্জু সকালবেলাটা গাছগুলোর পাশে বসে কাটায়। পানি দেয়। মাটি কুপিয়ে দেয়। এবং যেদিন মন-টন খুব খারাপ থাকে, তখন কথা বলে। হঠাৎ শুনলে মনে হবে সে গাছগুললার সঙ্গেই কথা বলছে। আসলে তা নয়, সে কথা বলে নিজের মনে। যেমন আজ সকালে সে বলছিল, মেয়েরা বড়ো হলে তাদের গায়ে হাত ভোলা ঠিক না। খুব খারাপ। রাগ হলে বুঝিয়ে বলতে হয়। বোঝালে সবাই বোঝে। বোঝলে যখন। বোঝ তখনই তো সবাই বড়ো হয়। ঠিক না?
অঞ্জু কথাগুলো বলছিল ফিসফিস করে। যেন খুব গোপন কিছু বান্ধবীকে বলা হচ্ছে। টিউবওয়েলে পানি নিতে এসে জহুর অবাক হয়ে ব্যাপারটা লক্ষ করল। অঞ্জু নিচু গলায় গাছের সঙ্গে কথা বলছে।
আমি কখনন আমার ছেলেমেয়ের সঙ্গে রাগ করব না। রাগ করলে কষ্ট পায় না? মন খারাপ হয় না? রাগ করার দরকার কী?
জহুর অবাক হয়ে ডাকল, এই অঞ্জু।
অঞ্জু চমকে পেছন ফিরল।
গাছের সঙ্গে কথা বলছি নাকি রে?
যাও মামা, গাছের সঙ্গে কথা বলব কেন?
অঞ্জু লজ্জায় বেগুনী হয়ে গেল।
রোজ এত সকালে উঠিস?
হুঁ। তুমিও ওঠ?
উঠি। জেলখানার অভ্যেস।
অঞ্জু উঠে দাঁড়াল। জহুর দেখল এই মেয়েটি দেখতে বেশ হয়েছে। ছোটবেলায় কদাকার ছিল। নাক দিয়ে সব সময় সর্দি পড়ত। বুকের পকেট ভর্তি থাকত রেললাইন থেকে আনা পাথরের টুকরোয়। জহুর যত বারই জিজ্ঞেস করত, পকেটে পাথর নিয়ে কী করিস তুই? তত বারই সে নাকের সর্দি টেনে বলত, পাথর না মামা, গোগেলের ডিম।
জহুর মুখে পানির ঝাপ্টা দিতে দিতে বলল, গোগেলের ডিমের কথা মনে আছে তোর? অঞ্জু লজ্জিত ভঙ্গিতে হাসতে লাগল।
কি রে, আছে?
আছে।
এখন আর গোগেলের ডিম আনিস না?
অজু সে কথার জবাব না দিয়ে বলল, চা খাবে মামা?
চা?
হুঁ, একটা হিটার আছে। চট করে বানাব।
ঠিক আছে আন। তুই এ রকম সকালবেলা উঠে একা-একা চা-টা খাস নাকি?
না, তোমার জন্যে বানাব।
অঞ্জু চা নিয়ে আসবার পর জহুর একটা জিনিস লক্ষ করল, অঞ্জু যেন খুঁড়িয়ে। খুঁড়িয়ে হাঁটছে।
চিনি ঠিক আছে মামা?
ঠিক আছে।
অঞ্জু মামার পাশে বসে নরম গলায় বলল, তুমি কি আবার কলেজে ভর্তি হবে?
নাহ্।
তুমি কী করবে?
জহুর জবাব দিল না। অজু বলল, বাবা বলছিলেন তুমি তার সঙ্গে লঞ্চের ব্যবসা করবে।