মিটিংয়ের সময় এসে বলে গেছে।
ও।
চৌধুরী সাহেব নড়েচড়ে বসলেন; লক্ষণ মোটই ভালো নয়। এই সব নতুন পয়সাওয়ালা লোকজন ভেসে উঠতে চেষ্টা করছে। চৌধুরী সাহেব মৃদুস্বরে বললেন, নীলগঞ্জে সিনেমা হল হচ্ছে।
আর বলেন কেন, দেশটা অধঃপাতে যাচ্ছে।
চৌধুরী সাহেব উঠে পড়লেন।
ডাব আনতে গেছে, একটু বসেন চৌধুরী সাহেব।
নাহ।
একটু বসেন। এসে পড়বে।
চৌধুরী সাহেব বসলেন না।
একটা রিকশা ডেকে দিই চৌধুরী সাহেব?
রিকশা লাগবে না।
নীলগঞ্জ বদলে যাচ্ছে। রিকশা পাওয়া যায় এখন। রাস্তাঘাটে অচেনা লোকজন দেখা যায়। বড়ো বড়ো অফিসাররা এখন আর চৌধুরী সাহেবের বাড়ি এসে ওঠেন না। তাদের জন্যে সরকারী ডাকবাংলা হয়েছে।
প্রচণ্ড রোদ উপেক্ষা করে চৌধুরী সাহেব হাঁটতে লাগলেন। তৃষ্ণা পেয়েছে। ডাবটা খেয়ে এলে হত। পাশ ঘেঁষে খালি রিকশা যাচ্ছে একটিা চৌধুরী সাহেব ভারি গলায় বললেন, এই থাম।
রিকশা থামল না। রিকশাওয়ালা সরু গলায় বলল, ভাড়া যাইতাম না।
নীলগঞ্জে এখন অনেকেই তাঁকে চেনে না। তিনি প্রচণ্ড একটা ধমক দিতে গিয়েও দিলেন না।
মসজিদের কাছাকাছি এসে শুনলেন ওয়াজ হচ্ছে। মসজিদের ইমাম সাহেব নতুন এসেছেন। আগের ইমাম সাহেবের ঘর-সংসার ছিল। ইনি এখনো বিয়েটিয়ে করেন নি। হাতে সম্ভবত কাজকর্ম কিছু নেই। সময়ে-অসময়ে মাইক ভাড়া করে নিয়ে আসেন। চৌধুরী সাহেব শুনলেন, ভাইসব, হাদিস-কোরানের কথা আজকাল কেউ শুনে না। মেয়েরা পর্দাপুশিদা করেন। হাটে-ঘাটে গজে-গ্ৰামে যুবতী মেয়েরা নাভির নিচে কাপড় পরে ঘুরে বেড়ায়–
ইমাম সাহেব অল্পবয়স্ক বলেই যুবতী মেয়েদের কথা তার ওয়াজে বারবার আসে। ওয়াজের ফাঁকে-ফাঁকে কোরান শরীফের আয়াত পড়া হয়। তাঁর কণ্ঠ অসম্ভব মধুর বলেই শুনতে বড়ো ভালো লাগে। কিন্তু আজ লাগছে না। চৌধুরী সাহেবের ইচ্ছা হল ইমাম সাহেবকে ডেকে একটা ধমক দেন। কিন্তু তা দেওয়া সম্ভব নয়। লোকটি আল্লাহ-খোদার নাম নিচ্ছে।
কাঁঠাল গাছের নিচে
জহুর কাঁঠাল গাছের নিচে মোড়া পেতে বসে ছিল। বাড়ির অন্য কেউ এখনন ঘুম থেকে ওঠে নি। জেলখানার অভ্যেস জহুরের এখনন আছে, সূর্য ওঠার আগে ঘুম। ভাঙে। জহুর দেখল এই সাতসকালে সাইফুল ইসলাম হনহন করে আসছে। এই নিয়ে পরপর তিন দিন এল।
স্লামালিকুম জহুর ভাই।
ওয়ালাইকুম সালাম। কি ব্যাপার?
জহুর ভাই, আজকে ঠিক করেছি থানায় গিয়ে একটা ডাইরি করাব।
বেশ তো, করান।
আপনার কাছে একটা পরামর্শের জন্যে আসলাম।
এর মধ্যে আবার পরামর্শ কি?
না, এই বিষয়ে না। অন্য বিষয়ে।
জহুর লক্ষ করল সাইফুল ইসলাম আজ আবার একটু বিশেষ সাজগোজ করে এসেছে। ঘাড়ের কাছে পাউডারের সূক্ষ প্রলেপ। মিষ্টি একটা সেন্টের গন্ধও আসছে গা থেকে। সাইফুল ইসলাম কেশে গলা পরিষ্কার করে বলল, ভাবছি পত্রিকার অফিসে একটা চিঠি লিখব।
হারমোনিয়াম চুরির খবর পত্রিকা ছাপবে না।
জ্বি-না, সেইটা না। থানাতে এত বড়ো একটা খুন হয়ে গেল, সেই বিষয়ে।
ও।
বেনামে একটা চিঠি দিয়ে দেই, কি বলেন জহুর ভাই?
বেনামী চিঠি ওরা ছাপবে না।
সেই জন্যেই একটা পরামর্শ করতে আসলাম। ইয়ে, অন্য কারোর নাম দিয়ে দিলে কেমন হয়?
কার নাম দেবেন?
তাও তো কথা। ইয়ে, আপনার দুলাভাই শুনম চন্দ্রপুর গেছেন?
হুঁ।
ফিরবেন কবে?
কাল-পরশু ফিরবেন।
সাইফুল ইসলাম একটা স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলল।
দুলাভাইকে কিছু বলতে চান?
জ্বি-না, জ্বি-না।
সাইফুল ইসলাম চুপচাপ বসে রইল। এক সময় বলল, টুনীকে বলেছিলাম সিও সাহেবের বাসায় গিয়ে গলাটা সাধতে। ইমনের সরগম দিয়ে দিয়েছিলাম, সে যায় না। আসলাম যখন, তাকে বলেই যাই, কি বলেন?
ঠিক আছে, বলে যান। চা-ও খেয়ে যান।
গানের মধ্যে সরগমটাই আসল। গলা যত ভালোই হোক, সাধনা না থাকলে সব শেষ।
জহুর জবাব দিল না। সাইফুল ইসলাম রুমাল দিয়ে নাক মুছতে মুছতে বলল, এই যে কয়েক দিন কিছু করি নাই–এতেই আমার গলা টাইট হয়ে গেছে। সঙ্গীতের মতো কঠিন কিছু নাই।
নাশতা নিয়ে এল অঞ্জু
নাশতা নিয়ে এল অঞ্জু। বাইরের লোক আছে বলেই কিনা কে জানে, আজ একটু বিশেষ ব্যবস্থা দেখা গেল। রুটির বদলে পরোটা তৈরী হয়েছে। ডিম ভাজার সঙ্গে সেমাই দেওয়া হয়েছে। একটি পিরিচে আবার পাকা পেপে টুকরো করে কাটা। সাইফুল ইসলাম বলল, ইয়ে, টুনীর সঙ্গে একটা কথা বলার ছিল। ও আর গান শিখতে যায় না।
অঞ্জু হাসিমুখে বলল, আপার বিয়ে ঠিক হয়েছে তো, সে এখন কোথায়ও যায় না।
বিয়ে ঠিক হয়েছে, কবে?
এই তো, কয়েক দিন।
ও।
ছেলে খুব ভালো। খুব সুন্দর চেহারা।
সাইফুল ইসলাম অবাক হয়ে অঞ্জুর দিকে তাকিয়ে রইল। আমাকে কেউ কিছু বলে নাই। ইয়ে, তাকে বল একটু আসতে।
টুনী ঘরের ভিতর ঢুকল না। দরজার পাশে দাঁড়াল। অঞ্জুর কাছে মনে হল টুনীর চোখ দুটি অস্বাভাবিক ফোলা-ফোলা। যেন প্রচুর কান্নাকাটি করে এসেছে।
টুনী স্বরে বলল, স্যার ডেকেছিলেন?
হুঁ।
কিছু বলবেন?
না, বলব আর কি? সিও সাহেবের বাসায় যাও না। ভাবলাম…
টুনী তাকিয়ে রইল। সাইফুল ইসলাম কথার মাঝখানে থেমে গেল। যেন আর তার কিছু বলার নেই। টুনী বেশ খানিকক্ষণ অপেক্ষা করে করে রান্নাঘরে চলে গেল।
অঞ্জু চায়ের চিনি আনতে গিয়ে দেখে টুনী রুটি বেলছে। তার চোখে সূক্ষ্ম জলের রেখা। অজু কিছু বলল না। তার নিজেরও কান্না আসতে লাগল।
চুরি তো তিন-চার দিন আগে হয়েছে, এত দিন পর আসলেন যে?