অঞ্জু বলল, আমার একার জন্য খাটটা ঠিক আছে। আষাঢ় মাস পর্যন্ত কষ্ট করতে হবে।
টুনী কিছু বলল না। অঞ্জু বলল, ছেলেটাকে পছন্দ হয়েছে তো আপা?
মন্দ কী?
আমার কাছে ভালোই লাগল। ব্যবসা করে মনেই হয় না।
কেন, ব্যবসা করলেই মানুষ খারাপ হয় নাকি? সবাই তো আর বাবার মতো না।
কথার কথা বললাম, রাগছ কেন?
রাগছি না।
তোমার গানও থাকল।
ঐ সব থাকবে-টাকবে না। বলতে হয় তাই বলেছে। টুনী শুয়ে পড়ল। শোবার আগে জানালা বন্ধ করার নিয়ম। আজ আর কেউ জানালা বন্ধ করল না। ঠাণ্ডা বাতাস দিচ্ছে, বেশ লাগছে। অঞ্জু এক বার বলল, জানালা খোলা থাকলে বাবা রেগে যাবে।
যাক রেগে।
অঞ্জু মৃদু স্বরে বলল, বিয়েটা তোমার ভালোই হবে আপা।
ভালো হলেই ভালো।
চৌধুরী সাহেব সম্পর্কটা ভালো এনেছেন, তাই না আপা?
কি জানি।
মানুষ তো আর চিরকাল খারাপ থাকে না।
হুঁ।
তোমার কি মনে হয়, মামা চৌধুরী সাহেবের চাকরিটা নেবে?
আমার কিছু মনেটনে হয় না। বকবক করিস না, ঘুমা।
অঞ্জুর হঠাৎ মনে হল টুনী কাঁদছে। সে অবাক হয়ে বলল, আপা কাঁদছ না-কি?
টুনী জবাব দিল না।
খুঁটি পোঁতা হচ্ছে
নীলগঞ্জ রেলস্টেশনের উত্তরের ফাঁকা জায়গাটায় চার-পাঁচ জন লোক কী যেন করছে। খুঁটি পোঁতা হচ্ছে। এক জনের হাতে কাগজ-পেন্সিল। সে গরমের মধ্যেও একটা হলদে রঙের কোট পরে আছে। চৌধুরী সাহেব রেলস্টেশন থেকে ব্যাপারটা দেখতে পেলেন। হচ্ছেটা কি? কোনো সরকারী অফিস-টফিস নাকি? তাঁর তো তাহলে জানার কথা। অবশ্যি আজকাল আর আগের মত খোঁজখবর রাখতে পারেন না। কিছুদিন আগেই হঠাৎ শুনলেন নীলগঞ্জে একটা অয়েল মিল বসান হয়েছে। বিদেশী লোকজন হুট-হাট করে কাজ করে। আগেভাগে কাউকে কিছু বলে না। চৌধুরী সাহেব খবর নিয়ে জানলেন, জন খাঁ অয়েল মিল দিয়েছে। ভাটি অঞ্চলের নতুন ধনী। জলমহালে পয়সা করে এখানে পয়সার গরম দেখাতে এসেছে। চৌধুরী সাহেব এক দিন গেলেন অয়েল মিল দেখতে। মিলের কাজকর্ম এখনন শুরু হয় নি, ভিত পাকা করা হচ্ছে। জনু খাঁ খুবই খাতির করল। দাঁত বের করে বলল, গরিবের ঘরে থতির পা।
আসলাম আপনার মিল দেখতে।
দেখবার কিছু নেই জনাব। গরিবী হালতে শুরু করলাম।
গরিবী হালত বলে অবশ্যি মনে হল না। নানান কিসিমের লোকজন দেখা গেল। জনু খাঁ পানির দেশ থেকে দলবল নিয়ে এসেছে। চৌধুরী সাহেব বললেন, শুকনার দেশে বসত করবেন মনে হয়।
তা ঠিক, চৌধুরী সাব। পানির দেশে ডাকাইতের ভয়টা বেশি।
চোর-ডাকাত তো সবখানেই আছে।
শুকনা দেশের ডাকাইত আর পানির দেশের ডাকাইত–কী যে আপনি কন চৌধুরী সাব! হেঁ-হেঁ-হেঁ।
বিদেশী লোকজন ঢুকে পড়ছে নীলগঞ্জে। লক্ষণ ভালো নয়। কিছু করা দরকার। সেই বছর চৌধুরী সাহেব সরিষার ব্যবসা করবেন ঠিক করলেন। পিডিপির ইঞ্জিনীয়ারদের কি-না-কি বললেন, যার ফলে একটা ট্রান্সমিটার নষ্ট হয়ে গেল। গোটা মাসে বাতি জ্বলল মিটমিট করে। জনু খাঁ ছ মাসের মাথায় অয়েল মিল বিক্রি করে ফেলল।
চৌধুরী সাহেব স্টেশনের উত্তরের ফাঁকা জায়গায় এসে হাজির হলেন। কড়া বোদ উঠেছে। ছাতা না আনায় তাঁর মাথা ঝাঁ-ব্য করতে লাগল। এই বছর বৃষ্টিবাদলা হচ্ছে না। খুব খারাপ লক্ষণ। চৌধুরী সাহেব গলা উচিয়ে ডাকলেন, এই যে, এই।
হলুদ কোট পরা লেকটা ঘাড় ঘুরিয়ে তাকাল। গায়ে কোট থাকলেও লোকটার চেহারা চাষাড়ে। সে উদ্ধত স্বরে বলল, কী চান?
নাম কি তোমার?
উদ্ধত ধরনের লোকদের আচমকা তুমি করে বললে তাদের প্রতিরোধ ভেঙে যায় এটি একটি বহু পরীক্ষিত তথ্য। চৌধুরী সাহেব আবার বললেন, নাম কি তোমার?
নাম দিয়ে কী করবেন?
এইখানে হচ্ছেটা কি?
সিনেমা হল হবে। বিউটি ছায়াঘর।
করছেটা কে?
নেসারউদ্দিন সাহেব।
নেসারউদ্দিন সাহেবটা কে?
ময়মনসিংহের। উনার আরো দুইটা সিনেমা হল আছে। নেত্রকোণায় একটা, ময়মনসিংহে একটা।
লোকটি চৌধুরী সাহেবের প্রশ্নে নার্ভাস বোধ করছিল। তা কাটাবার জন্যেই সে সিগারেট ধরাল।
বিদেশী লোজন আসতে শুরু করেছে। ছোট নীলগঞ্জ এখন আর ঘোট নয়। আর কিছু দিনের মধ্যেই হয়তো যে-কেউ ফস করে তার সামনে সিগারেট ধরাবে। চৌধুরী সাহেব ক্লান্ত পায়ে হাটতে শুরু করলেন। রোদ বড় কড়া। এই বয়সে এত রোদে হাঁটাচলা করা মুশকিল।
নীলগঞ্জ হাইস্কুলের কাছে আসতেই তার মনে হল আজ সকালে স্কুল কমিটির মিটিং ছিল, তিনি আসতে পারেন নি। এরকম ভুল তাঁর হয় না। হওয়াটা ঠিক নয়। বয়সের লক্ষণ। চৌধুরী সাহেব নীলগঞ্জ স্কুলে ঢুকে পড়লেন। হেডমাষ্টার সাহেবের ঘরে ফ্যান আছে। কিছুক্ষণ বিশ্রাম নিয়ে রওনা হওয়া ভালো। মিটিংয়ে কিছু হয়েছে। নাকি তাও জানা দরকার। নীলগঞ্জ স্কুলের হেডমাষ্টার সাহেব লোকটি মহা চালবাজ এবং মহা ধূর্ত। ধূর্ত লোকজন সময়ে অত্যন্ত বিনয়ী হতে পারে। এইটি চৌধুরী সাহেবের ভালো লাগে। হেডমাষ্টার সাহেব খুবই উদ্বিগ্ন হয়ে বললেন, শরীরটা খারাপ নাকি চৌধুরী সাহেব?
নাহ্।
হেডমাষ্টার সাহেব স্কুলের দপ্তরীকে পাঠালেন ডাব আনতে।
চৌধুরী সাহেব বললেন, কাজে আটকা পড়েছিলাম। মিটিং হয়েছে?
জ্বিনা, আপনি ছাড়া মিটিং হবে কি? বুধবারে ডেট দিয়েছি। বুধবারে কোনো অসুবিধা নাই তো?
নাহ্।
হেডমাষ্টার সাহেব গলার স্বর দু ধাপ নিচে নামিয়ে বললেন, সোবাহান মোল্লা স্কুল ফাণ্ডে দশ হাজার টাকা দিয়েছে। নতুন পয়সা হয়েছে আর কি। হা-হা-হা।
চৌধুরী সাহেব ভ্রূ কুঁচকে বললেন, কবে দিল?