বাবলু আর বাহাদুর নিঃশব্দে একটা স্কেল নিয়ে টানাটানি করছিল। দবির মিয়া দুজনের কানে ধরে প্রচণ্ড শব্দে মাথা ঠুকে দিল। দু জনের কেউ টু শব্দ করল না। অঞ্জু মশারি খাটাচ্ছিল, দবির মিয়া তার গালেও একটা চড় কষাল।
পড়াশোনা নাই?
অন্ধকারে পড়ব কীভাবে?
আবার মুখে-মুখে কথা?
দবির মিয়া দ্বিতীয় একটি চড় কল। অনুফা মাথা উচু করে বলল, এত বড় মেয়ের গায়ে হাত তোলা ঠিক নয়।
তুই চুপ থাক।
তুইতোকারি করছ কেন?
বললাম চুপ।
অঞ্জুর গালে আঙুলের দাগ বসে গেছে। সে এমনভাবে মশারি খাটাচ্ছে যেন কিছুই হয় নি। টুনী ভয়ে-ভয়ে বলল, মাছটা মনে হয় একটু নরম।
দবির মিয়ার মুখ তেতো হয়ে গেল। দেখেশুনে কেনা হয় নি। দেখেশুনে না কিনলে এই হয়। ঈমান বলে কোন জিনিস মাছওয়ালার মধ্যে নেই। অনুফা ক্লান্ত গলায় বলল, কয়েকটা লেবুর পাতা দিস তরকারিতে।
মামা, আপনার গোসলের পানি দিয়েছি।
জহুর দেখল এই মেয়েটি ঘুরেফিরে তার কাছে আসছে। কথা-টথা বলতে চেষ্টা করছে। অন্যরা সবাই দূরে-দূরে। এই মেয়েটির খুব কৌতূহল।
মামা, আমি কল টিপছি, আপনি পানি ঢালেন।
কল টিপতে হবে না। তুই যা।
অঞ্জু মামার কথায় কান দিল না।
তুই কোন ক্লাসে পড়িস?
ক্লাস নাইন, সায়েন্স গ্রুপ।
আর টুনী?
বড়োপা পড়া ছেড়ে দিয়েছে। ম্যাট্রিক পাশ করতে পারে নাই। তাই বাবা বলল–আর পড়তে হবে না।
ও।
বড়আপার বিয়ের চেষ্টা হচ্ছে।
ও।
আগামী সোমবার দেখতে আসবে।
তাই নাকি?
জ্বি, বড়োআপার ইচ্ছা নাই বিয়ের।
ইচ্ছা নাই কেন?
কী জানি কেন। আমাকে কিছু বলে না। না বললে কি আর জানা যায় মামা?
জহুর জবাব দিল না। টিউবওয়েলের পানি সত্যি সত্যি ভীষণ ঠাণ্ডা। শরীর কাঁপছে। অঞ্জু মৃদু স্বরে বলল, মামা, তুমি এখন কী করবে?
কিছু ঠিক করি নাই।
তোমার কথা কিন্তু মামা আমার মনে ছিল। তুমি একটা গান গাইতে,–মাটিমে পৌরণ মাটিমে শ্রাবণ।
জহুর সারা মুখে সাবান মাখতে মাখতে হঠাৎ শব্দ করে হেসে উঠল।
অঞ্জু মৃদু স্বরে বলল, তোমার মনে নাই, না?
না। কিছু মনে নাই।
আমার কথাও মনে নাই?
নাহ।
রাজনৈতিক আলোচনা নিষিদ্ধ
নান্টুর চায়ের দোকানে রাজনৈতিক আলোচনা নিষিদ্ধ। দক্ষিণ দিকের দেয়ালে সে বড়ো করে নটিশ ঝুলিয়েছে–কোনো রাজনীতির আলাপ করিবেন না। রাজনীতির আলোচনার জন্যে কেউ চায়ের দোকানে যায় না। সেখানে আজানের সময়টা বাদ দিয়ে সারাক্ষণই গান বাজে। হিন্দী গান নয়–পল্লীগীতি। নান্টু পল্লীগীতির বড়ো ভক্ত। চায়ের স্টলটি মোটামুটি চালু। সন্ধ্যার আগে আগে এখানে পেঁয়াজু ভাজা হয়। পেঁয়াজু খাবার জন্যে অনেকে আসে। নীলগঞ্জ থানার সেকেণ্ড অফিসার সেপাই পাঠিয়ে রোজ এক টাকার পেঁয়াজু কিনিয়ে নেন। নান্টু অন্যদের টাকায় দশটা দেয় কিন্তু থানাওয়ালাদের জন্যে বারটা।
আজ নান্টুর দোকানে গান হচ্ছিল না। পেঁয়াজুও ভাজা হচ্ছিল না। ভাজাভাজির কাজ যে করে তার জলবসন্ত হয়েছে। নান্টুর মেজাজ এ জন্যেই ঠিক নেই। মেজাজ ঠিক না থাকলে গান-বাজনা জমে না। নাট্ গান বাজায় নিজের জন্যে, কাস্টমারের জন্যে নয়। তাছাড়া তার নিজের শরীর বেজুত লাগছে। তারও সম্ভবত জলবসন্ত হবে। অনেকেরই হচ্ছে। সে ঠিক করল রাত আটটার ট্রেন চলে গেলেই দোকানের ঝাঁপ ফেলে দেবে। কিন্তু আটটার ট্রেন আসতে আজ অনেক দেরি করল। থানার ঘড়িতে নটার ঘন্টা পড়ারও অনেক পরে ট্রেনের বাতি দেখা গেল।
নান্টু দোকানের ঝাঁপ ফেলে বাইরে এসে অবাক হয়ে দেখল জহুর আলিকে। মাথা নিচু করে হাঁটছে। জহুর আলি ছাড়া পেয়েছে নাকি? তার ধারণা ছিল যাবজ্জীবন হয়েছে। নান্টু এক বার ভাবল ডাক দেয়। কিন্তু মনস্থির করতে করতে জহুর আলি জুমাঘরের আড়ালে পড়ে গেল। জহুর আলির হাতে একটা দুই ব্যাটারির টর্চ। সে মাঝে মাঝে টর্চের আলো ফেলছে। চেহারা আগের মতই আছে। একটু অবিশ্যি ভারি হয়েছে। হাঁটছে মাথা নিচু করে কুঁজো হয়ে। আগে বুক ফুলিয়ে হাঁটত।
নান্টু একটা বিড়ি ধরাল। ভালো লাগল না। মাথা ঝিমঝিম করে উঠছে। অর্থাৎ জ্বর আসছে। জ্বর আসার প্রথম লক্ষণই হচ্ছে প্রিয় জিনিসগুলো বিস্বাদ লাগে। পান মুখে দিলে পানটাকে এখন ঘাসের মতো লাগবে। নান্টু বিড়ি ফেলে দিয়ে গণপতির দোকান থেকে এক খিলি পান কিনল। গণপতি বলল, স্টল বন্ধ করে দিলেন?
হুঁ।
রফিকের নাকি বসন্ত?
জলবসন্ত।
ও, আমি শুনলাম আসল জিনিস।
নান্টু পানের পিক ফেলে বলল, জহুর আলি ছাড়া পেয়েছে।
গণপতি চোখ বড়ো বড়ো করে বলল, কার কাছে শুনলেন?
দেখলাম নিজের চোখে।
নান্টু বাড়ির পথ ধরল। অলকা ডিসপেনসারির কাছে তার সাথে দেখা হল সাইফুল ইসলামের। সাইফুল ইসলাম রাত দশটার দিকে তার স্টলে এক কাপ চা আর একটা নিমকি খায়। নান্টু বলল, দোকান বন্ধ আজকে।
এত সকালে?
শরীরটা ভালো না, জ্বর।
ও।
নান্টু মুখ থেকে পানটা ফেলে দিল। বিস্বাদ। জ্বর তাহলে সত্যি-সত্যি আসছে। সাইফুল ইসলাম সিগারেট ধরাল। নান্টুর বমি-বমি লাগছে। ধোঁয়াটাও অসহ্য লাগছে। নান্টু একদলা থুথু ফেলে বলল, জহুর আলি ছাড়া পেয়েছে, জানেন নাকি?
জহুর আলি কে?
নান্টু কিছু বলল না। এ নতুন লোক। দু বছর আগে এসেছে। এরা কিছুই জানে না। সাইফুল ইসলাম আবার জিজ্ঞেস করল, জহুর আলিটা কে?
নান্টু জবাব দিল না। তার মাথা ঘুরছে। পানের মধ্যে জর্দা ছিল নিশ্চয়ই।
জহুর আলিটা কে?
আপনে চিনবেন না। বাদ দেন।