জহুর তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকাল। অন্ধকার হয়ে গেছে, মুখ দেখা যাচ্ছে না।
আপনি বাসায় থাকবেন জহুর ভাই?
আমি থাকব।
এসপি সাহেব মৃদু গলায় বললেন, তুমি মা আরেকটি গান গাও।
আর কোন গান তো জানি না।
এসপি সাহেব বড়ই অবাক হলেন, একটি গানই জান?
জ্বি।
আশ্চর্য।
চৌধুরী সাহেব নিজেও খুব অবাক হয়েছেন। গান-বাজনা তিনি বিশেষ বোঝন না, তবু তাঁর মনে হল এই মেয়েটির মতো সুন্দর গলা তিনি বহু দিন শোনেন নি। এসপি সাহেব বললেন, গানটি তুমি আরেকবার গাও। নাম কি তোমার মা?
টুনী।
দবির মিয়া বলল, ওর ভালো নাম সুলতানা খানম।
আপনার মেয়ে বুঝি?
জ্বি স্যার।
এই মেয়ে খুব নাম করবে। আপনি দেখবেন, নাম করবে।
দবির মিয়া ঠাণ্ডা গলায় বলল, গৃহস্থ ঘরের মেয়ে গান-বাজনা আর কী করবে? এই সব আমাদের জন্যে না স্যার।
এসপি সাহেব রাগী চোখে তাকালেন। কঠিন ও তীক্ষ্ণ চাউনি।
খয়েরী রঙের একটা শাড়ি
মিনু ভাবী খয়েরী রঙের একটা শাড়ি পরেছেন। লণ্ঠনের আলোয় তাঁর মুখখানি করুণ দেখাচ্ছে। তিনি মৃদু স্বরে বললেন, চা খাবেন জহুর ভাই?
জ্বি-না।
বৃষ্টি হবে আজ রাতে। ঘনঘন বিজলি চমকাচ্ছে। বাড়ি ফিরে যাওয়া উচিত, কিন্তু জহুর উঠল না। ঘাড় ঘুরিয়ে ঘরের সাজসজ্জা দেখতে লাগল। চারদিকে মেয়েলি স্পর্শ আছে। দেখেই বোঝা যায়, এখানে বহুদিন ধরেই কোন পুরুষমানুষ থাকে না।
আপনার চলে কীভাবে ভাবী?
চৌধুরী সাহেব আমার জন্যে একটি চাকরির ব্যবস্থা করে দিয়েছেন।
তাই নাকি?
হুঁ। আমার জন্যে অনেক করেছেন।
জহুর মৃদু হাসল। মিনু নরম স্বরে বলল, তাঁর সাহায্য নিতে ইচ্ছা হয় নি, কিন্তু না নিয়েও কী করব বলেন?
তা ঠিক।
মিনু খানিকক্ষণ চুপচাপ বসে রইল।
ঝড়-বৃষ্টি হবে, আমি উঠি ভাবী।
বসেন না। আরেকটু বসেন।
জহুর ইতস্তত করে বলল, আমার এ রকম আসা ঠিক না, লোকজন নানান কথা বলতে পারে।
বলুক। আমি এখন এই সব নিয়ে মাথা ঘামাই না। কত কথা রটল আমাকে নিয়ে, বুঝলেন জহুর ভাই। বিধবা মেয়েদের বড়ড়া কষ্ট।
জহুর উঠে দাঁড়াল।
ছাতা এনেছেন?
জ্বি-না।
আমারটা নিয়ে যান। বৃষ্টি আসবে।
না, থাক।
থাকবে কেন জহুর ভাই? নিয়ে যান।
হারিকেন হাতে মিনু চাপা স্বরে বলল, শহরে একটা ঝামেলা হচ্ছে, সেটা তো জানেন। একটা লোককে মেরে ফেলেছে।
জানি।
জহুর ভাই, এই সব নিয়ে আপনি কোনো কথাবার্তা বলবেন না।
এই কথা বলছেন কেন?
আপনি তাহলে আবার অসুবিধায় পড়বেন। জেলে-টেলে দিয়ে দেবে।
জহুর অস্পষ্ট স্বরে বলল, আমাকে জেলে দিলে কারো তো কোনো ক্ষতি নেই ভাবী।
মিনু সে-কথার জবাব দিল না। হারিকেনটা হাতে নিয়ে মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে রইল।
ঘনঘন বিজলি চমকাচ্ছে। রাতে খুব ঝড়-বৃষ্টি হবে। জহুর একটা সিগারেট ধরিয়ে হালকা গলায় বলল, যাই ভাবী। মিনু ছোট্ট একটা নিঃশ্বাস ফেলল।
বাতাস দিতে শুরু করেছে। ভেজা গন্ধ আসছে। দূরে কোথায়ও বৃষ্টি নেমেছে বোধহয়। জহুর মৃদু স্বরে বলল, যাই আজ।
মিনু কিছু বলল না।
সাইফুল ইসলাম রাত এগারটার সময়
সাইফুল ইসলাম রাত এগারটার সময় এসে উপস্থিত। জহুর মশারি ফেলে ঘুমাবার আয়োজন করছিল। সাইফুল ইসলামকে দেখে অবাক হয়ে বেরিয়ে এল।
জহুর ভাই, আমি বলেছিলাম–আসব।
এত রাতে আসবেন ভাবি নি।
নান্টুর দোকানে চা খাচ্ছিলাম। এত রাত হয়েছে টের পাই নাই।
ব্যাপার কি?
সাইফুল ইসলাম ইতস্তত করতে লাগল। জহুর বলল, বসেন, ঐ বেঞ্চিটাতে বসেন।
সাইফুল ইসলাম বসল না। জহুর বলল, বলেন শুনি, কি ব্যাপার।
আপনি বুঝি বারান্দাতে ঘুমান?
হুঁ।
সাপখোপের ভয় আছে কিন্তু। সময়টা খারাপ।
জহুর সিগারেট ধরাল।
নিন, সিগারেট নিন।
সাইফুল ইসলাম সিগারেট নিল। মৃদুস্বরে বলল, সিগারেট খাওয়া আমি ছেড়ে দিয়েছি জহুর ভাই। খরচে পোষায় না। টাকাপয়সার খুব টানটানি আমার।
ছাড়তে পারলে তো ভালোই।
পুরাপুরি ছাড়তে পারি নাই। মাঝেমাঝে খাই।
জহুর বলল, কি বলতে এসেছেন, বলেন।
সাইফুল ইসলাম মৃদু স্বরে বলল, আসেন, রাস্তার উপর দাঁড়িয়ে কথা বলি।
জহুর রাস্তায় নেমে এল। এতটুকু বাতাস নেই কোথাও। গাছের পাতা পর্যন্ত নড়ছে না। মেঘ-বৃষ্টি হবে এমন লক্ষণও নেই। ঝকঝক করছে আকাশ। সাইফুল ইসলাম চাপা গলায় বলল, মনটা খুব খারাপ জহুর ভাই। একটা মানুষ মেরে ফেলেছে, কিন্তু কেউ একটা কথা পর্যন্ত বলছে না।
কাকে মেরে ফেলেছে?
মনসুর। মনসুর আলি। পিটিয়ে মেরে ফেলেছে।
সাইফুল ইসলাম রুমাল বের করে ঘাড় মুছতে লাগল। থেমে থেমে বলল, পরশু রাতে মনসুর আলিকে দেখলাম। মাথা নিচু করে কবরের পাশে বসে ছিল।
কাকে দেখলেন?
মনসুর আলিকো কালকেও দেখেছি।
আপনার কথা বুঝতে পারছি না।
কালকে গরমের জন্যে মাঠের মধ্যে বসে ছিলাম। তখন দেখলাম। পরিষ্কার দেখলাম। হাতে চটের একটা বস্তা ছিল।
জহুর দীর্ঘ সময় চুপ করে রইল। তারপর সিগারেট ধরাল।
নিন, আরেকটা সিগারেট নিন।
সাইফুল ইসলাম হাত বাড়িয়ে সিগারেট নিয়ে পকেটে রেখে দিল।
কাল সকালে নাশতার পরে খাব।
জহুর মৃদু স্বরে বলল, যান, বাড়িতে গিয়ে ঘুমান। সকালে কথা বলব।
আপনি আমার কথা বিশ্বাস করেন নাই, না?
জহুর জবাব দিল না।
আপনি আমার সঙ্গে যদি আসেন তাহলে নিজের চোখে দেখবেন। আসেন জহুর ভাই।
আজকে আর যাব না কোথায়ও।
জহুর ভাই, একা-একা তো বাড়ি যেতে পারব না। ভয় লাগে। একটু এগিয়ে দেন।
জহুর হাঁটতে শুরু করল। সারা পথে আর কোনো কথাবার্তা হল না। কবরখানার পাশ দিয়ে যাবার সময় সাইফুল ইসলাম মৃদু স্বরে বলল, আজকে নাই।