সকালেই উঠেছি।
রাতে ঘুম ভালো হয়েছিল?
হ্যাঁ।
খাওয়াদাওয়ার অসুবিধা হয় নাই তো স্যার?
খানিকটা হয়েছে। পোলাওটোলাও এখন খেতে পারি না। ইনডাইজেশন হয়।
স্যার, এখন থেকে সাদা ভাত পাঠাব।
ভাত পাঠানর তো আর দরকার নেই। আমি এগারটার ট্রেনে চলে যাচ্ছি।
চৌধুরী সাহেব অবাক হয়ে বললেন, রাত্রে আপনার জন্যে একটু গান-বাজনার ব্যবস্থা করা হয়েছিল।
না, রাত্রে থাকব না।
তদন্ত শেষ হয়ে গেছে নাকি স্যার?
কিছু জিজ্ঞাসাবাদ করব। পোস্ট মার্টেম রিপোর্টটা দেখলাম। নরম্যাল ডেথ।
এসপি সাহেব চায়ে চুমুক দিতেদিতে বললেন, দেশে চোর-ডাকাতের সংখ্যা কচুগাছের মততা বাড়ছে। এরা কিভাবে মরল, সেই সব নিয়ে কারো মাথাব্যথা নেই। আমি তো ভেবেছিলাম মিছিলটিছিল হবে, থানা ঘেরাওটোও হবে।
নীলগঞ্জ খুব ঠাণ্ডা জায়গা স্যার।
তাই দেখলাম। ঠাণ্ডা জায়গা এক বার গরম হয়ে গেলে কিন্তু মুশিবত হয়।
এসপি সাহেব সঙ্গের পিয়নটিকে সিগারেট দিতে বললেন। চৌধুরী সাহেব লক্ষ করলেন সাধারণ দেশী সিগারেটের একটি প্যাকেট দেওয়া হয়েছে। এর মানে কী? তিনি নাস্তার সঙ্গে দু প্যাকেট ফাইভ ফিফটি ফাইভ দিয়ে দিয়েছেন। সিগারেট মেরে দিচ্ছে নাকি? কী সর্বনাশ! ব্যাপারটা খোলাসা হওয়া প্রয়োজন। সরাসরি জিজ্ঞেস কাটা ঠিক হবে কিনা চৌধুরী সাহেব বুঝতে পারলেন না। এসপি সাহেব হঠাৎ অপ্রাসঙ্গিকভাবে বললেন, আমি একটা বেনামী চিঠি পেয়েছি।
চৌধুরী সাহেব নড়েচড়ে বসলেন।
চিঠিতে বলা হয়েছে মনসুর নামের লোকটিকে পিটিয়ে মেরে ফেলা হয়েছে। বেনামী চিঠির কোনো গুরুত্ব আমি দিই না।
চিঠিটা একটু দেখব স্যার?
না। আপনি দেখবেন কেন?
দেখলে বুঝতে পারতাম কে লিখেছে?
তার কোন দরকার নেই।
চৌধুরী সাহেব দেখলেন দবির মিয়া হনহন করে আসছে। তিনি বললেন, দবির মিয়াকে আসতে বলেছেন নাকি স্যার?
দবির মিয়া কে?
মনসুর থাকত যার বাড়িতে।
হ্যাঁ, বলেছি। আপনি এখন তাহলে উফ চৌধুরী সাহেব। আর শোনেন, দুপুরে ভাত পাঠাবেন না।
চৌধুরী সাহেব অস্বস্তি নিয়ে উঠে পড়লেন। সিগারেটের কথাটা তাঁর আর জিজ্ঞেস করা হল না। সাইফুল ইসলাম গলা সাধছে।
যা যারে কাগওয়া, পিয়াকে পাস।
কহিও খবরিয়া চৈন নহি ঘড়ি পল উন বিন…।
ব্যাটা গায় মন্দ না। দাঁড়িয়ে শুনতে ইচ্ছে করে। তিনি দাঁড়ালেন না, বাড়ি চলে এলেন। বসার ঘরে দু-তিন জন লোক বসে আছে। নিশ্চয়ই কোনো দরবাররবার। চৌধুরী সাহেব বলে দিলেন তাঁর শরীর ভালো নয়। এক জনকে পাঠালেন দবির মিয়ার দোকানে, অবশ্যি যেন দবির তাঁর সঙ্গে দেখা করে।
মনসুর আলি আপনার দোকানে কাজ করত।
জ্বি স্যার।
সে যে চোর, সেটা জানতেন?
জ্বি না। পরে জানলাম।
মনসুর ধরা পড়ার পরে চুরি ডাকাতি শুনলাম বন্ধ।
জি স্যার, এখনো হয় নাই।
দারোগা সাহেবের কাছে শুনলাম আপনার ছোট ভাই এক জন এসেছে।
ভাই না স্যার, আমার শ্যালক।
সে এখন করছে কী?
দবির মিয়া কপালের ঘাম মুছে শুকনো গলায় বলল, সে একটা নির্দোষী লোক। লোকজনের ষড়ুযন্ত্র এই অবস্থা স্যার।
এসপি সাহেব কিছু বললেন না। দবির মিয়া বলল, ছেলেটার জীবনটা নষ্ট হয়েছে স্যার। শুধু তার একার না, আমারও নানান ঝামেলা হচ্ছে। বড় মেয়েটার বিয়ে হচ্ছে না।
মেয়ের বিয়ের সাথে এর কী সম্পর্ক।
যে বাড়িতে এমন খুন-খারাবি করার লোক আছে সে বাড়িতে বিয়ে-শাদি কেউ করতে চায় না।
এসপি সাহেব আচমকা প্রসারে চলে গেলেন।
এই চিঠিটা কি আপনার শালার লেখা?
দবির মিয়া অবাক হয়ে চিঠিটা পড়ল।
মাননীয় এসপি সাহেব সমীপেবু,
জনাব,
বিনীত নিবেদন এই যে, গত বুধবার দিবাগত রাত্রে নীলগঞ্জ থানায় মনসুর আলি নামক এক নিরপরাধ ব্যক্তিকে খুন করা হইয়াছে। এই বিষয়ে আপনি যথাযথ ব্যবস্থা গ্রহণ করিবেন। নচেৎ ফল খারাপ হইবে। আমরা ঘাস খাইয়া জীবন ধারণ করি না। থানা পুলিশকে নীলগঞ্জের লোকেরা ভয় পায় না। পূর্বেও এই অঞ্চলে এই জাতীয় অন্যায় হইয়াছে। থানার যোগসাজসে নিরাপরাধ ব্যক্তিকে খুনের দায়ে জেল খাটিতে হইয়াছে।
দীর্ঘ চিঠি। দবির মিয়া চিঠিটা দু বার পড়ল। এসপি সাহেব আবার বললেন, চিঠিটা কি আপনার শালার লেখা?
স্যার বলতে পারলাম না। তার হাতের লেখা আমি চিনি না। তবে…?
তবে কি?
সে এরকম চিঠি-ফিঠি লিখবে না স্যার। সে গোঁয়ার ধরনের।
দবির মিয়া অত্যন্ত চিন্তিত মুখে দোকানে গেল। বরকত আলি কাশবাক্স সামনে নিয়ে গম্ভীর হয়ে বসে আছে। তার ভাবভঙ্গি যেন দোকানটা তারই। সে টেনেটেনে বলল, আজকেও আসতে দেরি করছেন। সকাল সকাল দোকান খোলা দরকার।
দবির মিয়া জবাব দিল না।
চাইর জন কাস্টমার ফিরত গেছে। আমি বলছি ঘন্টাখানিক পরে আসতে।
ভালো করছেন।
কাস্টমার হইল আপনের হাতের লক্ষ্মী। কাস্টমার ফিরত যাওয়া খুব অলক্ষণ।
দবির মিয়া গম্ভীর হয়ে বলল, আপনার কাজ শেষ হয়েছে?
কোন কাজের কথা কন?
দাবোগা সাহেবের সাথে দেখা করার কথা ছিল যে।
ও, সেইটা। ওসি সাহেব চার-পাঁচ দিন পরে যাইতে কইছেন। এখন থানায় খুব ঝামেলা যাইতেছে।
আরো চার-পাঁচ দিন থাকবেন তাহলে?
জ্বি।
আমার এখানে না, অন্যখানে থাকেন গিয়ে।
বরকত আলি স্তম্ভিত হয়ে গেল।
যামু কই আমি ভাইসাব?
যেখানে ইচ্ছা সেখানে যান।
বিস্মিত বরকত আলি চা খেতে গেল নাড়ুর দোকানে। চা খেয়ে মাথাটা ঠাণ্ডা করা দরকার।
বেলা প্রায় দশটা হয়েছে। সিক্সটিন ডাউনের আসবার সময়। নান্টুর দোকানে কামারদের ভিড় এই সময় সবচেয়ে বেশি। কাজেই সাইফুল ইসলাম যখন এসে বলল, নান্টু, একটা জরুরী কথা আছে আমার। একটু বাইরে আসা তখন সেসঙ্গত। কারণেই বিরক্ত হল।