দবির মিয়া উত্তর দিল না।
বাচ্চা দুইটা তোমারে যমের মতো ডরায়।
দবির মিয়া তারও উত্তর দিল না। আবার বাইরে গিয়ে বসল। তৃতীয় সিগারেট ধরিয়ে দবির মিয়া কাশতে লাগল। নাহু, আবার বিয়ে করাটা ভুল হয়েছে। মস্ত বোকামি। অনুফার আগের পক্ষের ছেলে দুটি তার বাপের কাছে থাকবে, এরকম কথা ছিল। কিন্তু সাত দিন পার না হতেই বাবলু আর বাহাদুর এসে হাজির। তারা কাউকে কিছু না বলে আট মাইল রাস্তা হেঁটে চলে এসেছে। তাদের দ জনকে পাওয়া গেল নীলগঞ্জের বাজারে। কোথায় কার বাড়ি যাবে কিছু বলতে পারে না। শুধু জানেনীলগঞ্জে তাদের মা থাকে। দুটি যমজ ছেলে নিমাইয়ের মিষ্টির দোকানে বসে কাঁদছে শুনে দবির মিয়া কৌতূহলী হয়ে দেখতে গেছে। তারপর মুখ গম্ভীর করে বাড়ি নিয়ে এসেছে। বাচ্ছা দুটি খালি হাতে আসে নি, প্যান্টের পকেট ভর্তি। করে তাদের মায়ের জন্যে কাঁচামিঠা আম নিয়ে এসেছে।
ছেলে দুটি বিন্দু। মহা বিচ্ছু। তাদের নানা খবর পেয়ে এসে নিয়ে গিয়েছিল। তিন দিন পরই রাত নটায় দু মূর্তি এসে হাজির। দবির মিয়া তক্ষুণি ফেরত পাঠাবার জন্যে ব্যবস্থা করল। বাদ সাধন টুনী।
না বাবা, থাকুক।
থাকুক মানে?
মায়ের সাথে থাকুক।
দবির মিয়ার বিরক্তির সীমা রইল না।
থাকার জায়গাটা কোথায়?
জায়গা না থাকলেও থাকবে। মাকে ছাড়া থাকতে পারে!
ধামড়া ধামড়া ছেলে, মাকে ছাড়া থাকতে পারে না–একটা কথা হল!
দবির মিয়া মহা বিরক্ত হল। কী যন্ত্রণায় বিরক্তির সঙ্গে-সঙ্গে টুনীর সাহস দেখেও সে অবাক হল। বাপের মুখে-মুখে কথা বলে, বেয়াদপির একটা সীমা থাকা দরকার।
দবির মিয়া ছোট্ট একটা নিঃশ্বাস ফেলল। খুট করে শব্দ হল একটা। দবির মিয়া ঘাড় ঘুরিয়ে দেখল, বাবলু বের হয়ে আসছে।
কী চাস তুই?
পেশাব করব।
শোয়ার আগে সারতে পারি না? বাঁদর কোথাকার। এক চড় দিয়ে দাঁত সবগুলো ফেলে দেব।
বাবলু বারান্দার এক কোণে প্যান্ট খুলে বসে রইল। দবির মিয়া আড়চোখে দেখল বাবলু ভীত চোখে বারবার দবির মিয়ার দিকে তাকাচ্ছে।
বারান্দায় বসে পেশাব করতে নিষেধ করি নাই?
বাবলু পাংশু মুখে উঠে দাঁড়াল।
পেশাব শেষ হয়েছে?
না।
শেষ কর।
বাবলু আবার বসল। দবির মিয়া বলল, স্কুলে যাস তো রোজা
যাই।
পড়াশোনা করিস তো ঠিকমতো?
হুঁ।
হুঁ আবার কি? বল জ্বি।
জ্বি।
পড়াশোনাটা ঠিকমতত করা দরকার।
বাবলু ঘরের দিকে যাচ্ছিল। দবির মিয়া হঠাৎ কী মনে করে মৃদু স্বরে বলল, এই বাবলু, বস দেখি এখানে।
বাবলু অবাক হয়ে পাশে এসে বসল।
কিচ্ছা শুনবি নাকি একটা? পিঠাপুলি রাক্ষসের কিচ্ছা?
স্তম্ভিত বাবলু কোনো উত্তর দিল না।
তুই আমারে ডরাস নি?
হুঁ।
হুঁ কিরে ব্যাটা? বল জ্বি।
জ্বি।
ডরাইস না। ডরের কিছু নাই। কিচ্ছা শুনবি?
হুঁ।
আবার হুঁ।
জ্বি। দবির মিয়া পিঠাপুলি রাক্ষসের কিচ্ছা শুরু করে।
অনুফা ঘুম ভেঙে অবাক হয়ে দেখল, দবির মিয়া মৃদু স্বরে বাবলুকে কী যেন বলছে। গল্প নাকি? তার চার বছরের বিবাহিত জীবনে এমন অদ্ভুত ঘটনা সে দেখে নি।
সাইফুল ইসলাম ভোরবেলা গলা সাধে
সাইফুল ইসলাম ভোরবেলা গলা সাধে। তার গলা ভালো। গানের মাষ্টারদের মতো কর্কশ এবং শ্লেষ্ম-জড়ান নয়। চৌধুরী সাহেব সাইফুল ইসলামকে সহ্য করতে না পারলেও ভোরবেলায় তার ঘরের সামনে দিয়ে হাঁটার সময় তাঁর কান উত্তর্ণ হয়ে থাকে। এবং নিজের মনেই বলেন–মন্দ না। আজও শুনলেন–
যা যারে কাগণ্ডয়া পিয়াকে পাস
কহিও খবরিয়া নৈ নহি ঘড়ি পল উন বিন…
চৌধুরী সাহেবের হাঁটার গতি কমে গেল। মনে-মনে বললেন-বাহু, ব্যাটা তো ভালো গাইছে। গান থেমে গেল সঙ্গে সঙ্গে। খুট করে দরজা খুলে সাইফুল ইসলাম বের হয়ে এল। তার চোখ লাল। মুখ শুকিয়ে লম্বাটে হয়ে গেছে। সে দ্রুত এগিয়ে এল চৌধুরী সাহেবের দিকে। চৌধুরী সাহেব লক্ষ করলেন সে আসছে খালি-পায়ে।
মালিকুম চৌধুরী সাব।
ওলায়কুম সালাম।
আমি জানালা দিয়ে দেখলাম আপনি আসছেন। একটা কথা ছিল আপনার সঙ্গে।
তোমার শরীর খারাপ নাকি?
জ্বি। রাতে আমার ঘুম হয় না।
যা গরম, ঘুম না হওয়াই স্বাভাবিক।
চৌধুরী সাব, আপনাকে একটা কথা বলতে চাই।
বল।
একটু ভেতরে এসে যদি বসেন।
বল, এইখানেই বল।
সাইফুল ইসলাম বিড়বিড় করতে লাগল। চৌধুরী সাহেব বিরক্ত হয়ে বললেন, বিষয়টা কী?
চৌধুরী সাব, গতকাল রাত্রে আমি জুমাঘরের পাশ দিয়ে আসছিলাম। মনসুরের যে কবর আছে তার ধার দিয়ে আসবার সময় একটা জিনিস দেখলাম।
কি জিনিস?
দেখলাম মনসুর বসে আছে কবরের পাশে। আমাকে দেখে সে হাসল।
কে বসে আছে বললে?
মনসুর।
কি ছাগলের মতত কথাবার্তা
সাইফুল ইসলাম বিড়বিড় করতে লাগল। চৌধুরী সাহেব ভারি গলায় বললেন, তুমি ডাক্তার-ফাক্তার দেখিয়ে ঘুমের ওষুধ-টষুধ খাও।
চৌধুরী সাহেব আর দাঁড়ালেন না। তাঁর অবশ্যি ব্যাপারটি ভালো করে শোনার ইচ্ছে ছিল। কিন্তু সময় নেই। ময়মনসিংহ থেকে এসপি সাহেব এসেছেন গত রাতে। তাঁর থাকার ব্যবস্থা হয়েছে ডাকবাংলায়। তাঁর খাবার-দাবার চৌধুরী সাহেবের বাড়ি থেকে যাচ্ছে। গত রাতে কথা হয়েছে চৌধুরী সাহেব সকালবেলা ডাকবাংলায় এসে চা খাবেন। দেরি করা যায় না। এসপি সাহেব লোকটিকে একটু কড়া ধাঁচের বলে মনে হয়েছে। সিএসপি অফিসারদের মতো। কিন্তু লোকটি দারোগা থেকে এসপি হয়েছে। এরা ভোঁতা ধরনের হয়ে থাকে, কিন্তু এ সেরকম নয়।
এসপি সাহেব একটা লুঙ্গি এবং হাতকাটা পাঞ্জাবি পরে বারান্দায় চেয়ারে, বসেছিলেন। টুর করতে আসা এসপি জাতীয় অফিসাররা লুঙ্গি পরে বসে থাকলে মানায় না। চৌধুরী সাহেব হাসিমুখে বললেন, কখন উঠলেন স্যার?