কত করে?
দামটা একটু বেশি। পাঁচ টেকা! আপনে একটা ফাইল রাখেন। টেকা লাগব না।
দবির মিয়া চা আনতে লোক পাঠাল। বরকত আলিকে তার ছেলের ব্যাপারে মোটই বিচলিত মনে হল না। চা খেতে খেতে বলল, কর্মফল, বুঝলেন ইসাব? ছেলেটারে কত কইলাম ব্যবসাপাতি দেখ। সূতিকা রোগের একটা ওষুধ আছিল, একটা আছিল বাতের, বাতনাশক কালে বড়ি। কিছুই শুনা না। মাথা খারাপ ছোট বয়স থেকেই।
ছেলের মরার খবর পেয়েছেন কবে?
বিষ্যুত বারে।
কে দিল খবর?
ললাকের মুখে শুনলাম। খুব আফসোসের কথা।
হুঁ।
তা শুনলাম, ওসি সাহেব দশ হাজার টেকা দিবে ক্ষতিপূরণ। ক্ষতিপূরণ টেকায় তো হয় না। তা কী করা বলেন?
ক্ষতিপূরণের কথাটা শুনলেন কোথায়?
লোকজনের মুখে শোনা। কথাটা কি সত্যি?
আমি জানি না। আপনি দেখেন খোঁজ নিয়ে।
আপনারে সাথে নিয়া একটু যাইতে চাই।
দবির মিয়া গভীর হয়ে বলল, যান, আপনে একাই যান।
কয়েকটা দিন আপনার এইখানে থাকা লাগতে পারে। আপনার কোনো অসুবিধা নাই তো জনাব?
না, অসুবিধা নাই। মনসুর আপনার ছেলে তো?
জ্বি, প্রথম পক্ষের সন্তান। অজুর পানি কই পাওয়া যায়, আছরের নামাজের সময় হইছে মনে হয়।
দবির মিয়া তাকে মসজিদটা দেখিয়ে দিল। ঠাণ্ডা গলায় বলল, জুঘরের গোরস্থানে মনসুরের কবর আছে। বললে ওরা দেখিয়ে দেবে।
বরকত আলিকে ছেলের ব্যাপারে খুব একটা চিন্তিত বলে মনে হল না। সে কালো ব্যাগ হাতে নিয়ে বাজারের রাস্তায় হাঁটাহাঁটি করল। নান্টুর দোকানে চা খেল। বিকালের ট্রেনে বরফ বোঝই বাক্সে যে-সব মাছ যায় সে-সব মাছ দর-দাম করল। নীলগঞ্জ শহরে একটা হেকিমী ওষুধের দোকান চলবে কিনা, সেই সম্পর্কে খোঁজ-খবর করল।
ওসি সাহেবের সঙ্গে দেখা করতে গেল মাগরেবের নামাজের পর। ওসি সাহেব ছিলেন না। সেকেণ্ড অফিসার তাকে বিশেষ সমাদর করলেন। নান্টুর দোকান থেকে পিয়াজু এনে খাওয়ালেন। নগদ পয়সা দিয়ে দু ফাইল শরিয়ত আলির স্বপ্নপ্রাপ্ত কৰ্ণশুদ্ধি আরক কিনে রাখলেন। বরকত আলি অভিভূত হয়ে পড়ল। চার পাশে এমন সব হামদর্দ লোকজন। আজকালকার যুগে এমন দেখা যায় না।
দবির মিয়া বিছানায় শোওয়ামাত্র
দবির মিয়া বিছানায় শোওয়ামাত্র ঘুমিয়ে পড়তে পারে। আজ রাতে নিয়মের ব্যতিক্রম হল। বিছানায় গড়াগড়ি করতে করতে রাত দুটা বাজল-ঘুম এল না। তার পাশে অনুফা ঘুমাচ্ছে মড়ার মত। মরেই গেছে কিনা, কে জানে। শ্বাস ফেলার শব্দ পর্যন্ত নেই। দবির মিয়া চাপা স্বরে বলল, এ্যাই, এ্যাই। কোনো সাড়া নেই। মেয়েরা বড় হয়েছে। এখন আর মাঝরাতে স্ত্রীকে ঘুম থেকে ডেকে ডেকে তোলা যায় না। মেয়েরা শুনে কি-না-কি ভেবে বসবে। দবির মিয়া অনুফাকে বড়ো কয়েকটি ঝাঁকুনি দিল। অনুফা বিড়বিড় করে পাশ ফিরল। তার ঘুম ভাঙল না। দবির মিয়া বিছানা ছাড়ল রাত দুটার দিকে। শুয়ে থাকার কোন মানে হয় না। যে-কোন কারণেই হোক ঘুম চটে গেছে। সে কাতালায় পরপর দুটি সিগারেট শেষ করল। বাইরেউলপাথাল হাওয়া। খালি গায়ে থাকার জন্যে শীতশীত করছে। এরকম হওয়ায় বারান্দায় বিছানা পেতে জহুর ঘুমায় কী করে কে জানে? দিনকাল ভালো না। এরকম খোলামেলা ভাবে বারান্দায় ঘুমান ঠিক না। জহুরের শত্রুর তো অভাব নেই। কিন্তু জহুর যেটা মনে করবে, সেটাই করবে। অন্যের কথা শুনলে কি আর আজ এই অবস্থা হয়? দবির মিয়া আরেকটি সিগারেট ধরাল।
জহুরের ব্যাপারে কিছু একটা করা দরকার, কিন্তু করবেটা কী? একটা লঞ্চের যোগাড় দেখার কথা ছিল, সেটা সম্ভব না। একা-একা লঞ্চ কেনা তার পক্ষে সম্ভব না। সফদর শেখের সঙ্গে কথা হয়েছিল, সে টাকা দিতে রাজি, কিন্তু জহুরকে রাখতে রাজি না।
বুঝেন তো দবির ভাই, নানান লোকে নানান কথা বলবে।
কী কথা বলবে?
সফদর শেখ তা আর পরিষ্কার করে বলে না, দাড়ি চুলকায়।
জহুর একটা নির্দোষ লোক, সেইটা জানেন আপনি সফদর সাব?
আরে ছিঃ ছিঃ, তা জানব না কেন? আমি কত আফসোস করলাম। এখন করি।
দবির মিয়া গম্ভীর হয়ে বলল, আফসোসে কোন ফয়দা হয় না।
ফয়দা হয় না ঠিকই, তবু আফসোস থাকাটা ভালো। লোকজনের তত আফসোস পর্যন্ত নাই। এই যে ছেলেটা আসল, কেউ কি বাড়িতে এসে ভালো-মন্দ কিছু বলেছে? না, বলে নাই। মানুষের কিছুই মনে থাকে না। চৌধুরী সাহেব তো ভালো মতেই আছেন। কয়েক দিন আগে ডিগ্রী কলেজের জন্যে অনেকখানি জমি দিলেন। নিজের পয়সার গার্লস স্কুলের একটা হোস্টল তৈরি করে দিলেন। বিরাট হলস্থুল। ময়মনসিংহের ডিসি সাহেব আসলেন। কত বড়ো বড়ো কথা; কৰ্মযোগী, নীরব সাধক, নিবেদিতপ্রাণ–দূর শালা।
দবির মিয়া কলতলা থেকে উঠে এসে বারান্দায় বসল। জহরকে কিছু একটাতে লাগিয়ে দেওয়া দরকার। বিয়ে-শাদি দেওয়া দরকার। বিয়ে দেওয়াটাও তো মুশকিল। কে মেয়ে দেবে? দেশে মেয়ের অভাব নেই। কিন্তু খুন করে ছ-সাত বছর জেল খেটে যে-ছেলে এসেছে, তার জন্য মেয়ে নেই। চৌধুরী সাহেব অবশ্যি একটি মেয়ের কথা বলেন। সম্পর্কে তাঁর ভাতিজী। মেয়েটিকে দেখেছে দবির মিয়া। শ্যামলা রঙ, বেশ লম্বা। দেখতে-শুনতে ভালোই। কিন্তু জহরকে বলারই তার সাহস হয় না। পুরনো কথা সব ভুলে গিয়ে নতুন করে সব কিছু শুরু করাই ভালো। বরফের মেশিনে ম্যানেজারীর চাকরিটা নিয়ে নিলে মন্দ কি?
বাহাদুর জেগে উঠেছে। বিকট চিৎকার শুরু করেছে অভ্যাস মতো। দবির মিয়া নিঃশব্দে ঘরে ঢুকে প্রচণ্ড একটা চড় কল। কান্না থেমে গেল সঙ্গে সঙ্গে। অনুফা বলল, কেন বাচ্চা দুইটারে মার?