মুশকিল কেন?
অঞ্জু জবাব দিল না।
বাবলুকে নিয়ে ঘুমিয়ে পড়।
অঞ্জু উঠে বাবলুকে কোলে নিয়ে বসল। হালকা গলায় বলল, টুনী আপা আজ সারা দুপুর কেঁদেছে।
কেন? আমি তো জানতাম ছেলে তার পছন্দ হয় নি।
তা হয় নি।
তবে কান্নাকাটি কি জন্যে?
অঞ্জু জবাব দিল না। প্রচণ্ড শব্দে বাজ পড়ল। বাতাসের বেগ বাড়তে লাগল। অঞ্জু অস্পষ্ট সুরে বলল, মামা, তোমাকে একটা কথা জিজ্ঞেস করব?
কী কথা?
তুমি নাকি বলেছিলে, জেল থেকে ফিরে এসে চৌধুরী সাহেবকে খুন করবে?
মনে নেই, বলতে পারি।
সত্যি সত্যি করবে না নিশ্চয়ই
জহুর জবাব না দিয়ে সিগারেট ধরাল। ঘরের মধ্যে এবার বাহাদুরের চিৎকার এবং দবির মিয়ার গর্জন শোনা যেতে লাগল, হারামজাদাদের যন্ত্রণায় শান্তিতে ঘুমানব উপায় নাই। সব কটাকে কচুকাটা করা দরকার।
মামা।
উঁ।
তুমি নাকি বদি চাচার বাসায় গিয়েছিলে?
জহুর খানিকক্ষণ চুপ করে থেকে বলল, কার কাছ থেকে শুনলি?
বাবা বলছিল ছোটমাকে। আড়াল থেকে শুনে ফেললাম।
জহুর চুপ করে গেল।
গিয়েছিলে নাকি মামা?
হুঁ।
ওদের ছেলেটাকে দেখেছ? খুব সুন্দর না?
খুব কিন্তু পাজি। দেখলে বোঝা যায় না। বিন্দু একেবারে।
এশার নামাজের পর
এশার নামাজের পর চৌধুরী সাহেব বাড়ি ফিরবার সময় লক্ষ করলেন জহুর হনহন করে বাজারের দিকে যাচ্ছে। চৌধুরী সাহেব গলা খাকারি দিলেন। জহুর তাঁর দিকে তাকাল, কিন্তু থামল না। যেমন যাচ্ছিল, তেমনি যেতে লাগল। তিনি ডাকলেন, এই
যে, জহুর না?
জহুর দাঁড়াল।
তোমার দুলাভাইয়ের সঙ্গে একটা জরুরী কথা ছিল।
বলব তাঁকে।
জহুর আর দাঁড়াল না। চৌধুরী সাহেব হটতে শুরু করলেন। জহুরের ভাবভঙ্গি তাঁর মোটও ভালো লাগছে না। এই সব ভালো লক্ষণ নয়। তিনি জহুর কী করছে না-করছে, সে সম্পর্কে কিছু খোঁজখবর নিয়েছেন। কিছুই করছে না। ঘরেই বসে সময় কাটাচ্ছে। কোনো মতলব পাকাচ্ছে নিশ্চয়ই। তাঁর নিজের কোনো ঝামেলায় জড়াতে এখন আর ইচ্ছা করছে না। বয়স হয়ে গেছে। শান্তিতে সময় কাটাতে ইচ্ছা হয়।
চৌধুরী সাহেব বাড়ির কাছে এসে দেখেন সাইফুল ইসলাম গেটের কাছে মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে আছে।
স্লামালাইকুম চৌধুরী সাব।
ওলায়কুম সালাম। কি ব্যাপার?
আপারে একটা কথা বলতে এসেছি, চৌধুরী সাব।
বল।
শুনছেন বোধ হয় এসপি সাব আসতেছেন তদন্তে।
হ্যাঁ, জানি।
এসপি সাবের সাথে একটা কথা বলতে চাই চৌধুরী সাব।
বলতে চাইলে বল। আমাকে বলছ কেন?
জ্বি?
আমাকে জিজ্ঞেস করছ কেন?
সাইফুল ইসলাম হাত কচলাতে লাগল।
কী বিষয়ে কথা বলতে চাও?
এ্যাঁই ইয়ে—আপনার গান-বাজনা নিয়ে। এসপি সাবে গান বাজনার খুব সমঝদার।
তোমার কথাবার্তা বুঝতে পারছি না। ব্যাপারটা কি?
সাইফুল ইসলাম আমতা-আমতা করতে লাগল। চৌধুরী সাহেব গম্ভীর গলায় বললেন, ভেতরের কথাটা কি বল তো।
সাইফুল ইসলাম রুমাল দিয়ে ঘাড় মুছতে মুছতে বলল, থানাওয়ালারা লোকটারে খুন করছে চৌধুরী সাব।
বলছে কে তোমাকে? সাইফুল ইসলাম জবাব দিল না।
জহুর বলছে নিশ্চয়ই। শোনো সাইফুল ইসলাম, তুমি বিদেশী মানুষ, কিছু জান-টান না। জহুরের স্বভাব-চরিত্ৰ তুমি জান না। সে যে খুন করেছিল সেইটা জান?
জ্বি, শুনছি।
মুক্তিযুদ্ধের সময় কমাণ্ডার আছিল, অনেক কাজকারবার করছে, বুঝলে? ডেঞ্জারাস লোক। যে যেটা বলে, সেটাই বিশ্বাস করতে হয় না। চিন্তা-ভাবনা করতে হয়। চিন্তা-ভাবনা করবার জন্যে আল্লাহ একটা মাথা দিয়েছে। বুঝলে?
চৌধুরী সাহেব হাঁপাতে লাগলেন। হঠাৎ করেই মেজাজ খারাপ হয়ে যেতে শুরু করেছে। সাইফুল ইসলাম বলল, জহুর ভাই আমাকে কিছু বলেন নাই।
চৌধুরী সাহেব চোখ লাল করে তাকালেন।
বিষয়টা আমার নিজের মনে আসল।
নিজের মনে আসল?
জ্বি।
কী করতে চাও তুমি?
সাইফুল ইসলাম রুমাল দিয়ে ঘনঘন নাক মুছতে লাগল।
কী করতে চাও তুমি?
কিছু করতে চাই না চৌধুরী সাব।
তাহলে খামোকা বকবক করছ কি জন্যে?
সাইফুল ইসলাম খকখক করে কাশতে লাগল।
যাও আমার সামনে থেকে।
সাইফুল ইসলাম অবাক হয়ে তাকিয়ে থাকল।
চৌধুরী সাহেবের ধৈর্যচ্যুতি হল। তিনি প্রচণ্ড একটা চিৎকার করলেন, যাও, ভাগ।
সাইফুল ইসলাম তাড়াতাড়ি পা ফেলতে গিয়ে বড় রকমের একটা হোঁচট খেল।
নবীনগর থেকে মনসুরের বাবা
নবীনগর থেকে মনসুরের বাবা এসে হাজির। বরকত আলি। দবির মিয়ার ধারণা ছিল, মনসুরের নিকট আত্মীয় কেউ নেই। মনসুর প্রায়ই বলত, একলা মানুষ আমি, একটা মুটে পেট। কিন্তু মনসুরের বাবার কাছে জানা গেল–মনসুরের পাঁচ বছর বয়সের একটা ছেলে আছে। ছেলেটা তার নানাবাড়ি থাকে। তার মার বিয়ে হয়ে গেছে অন্য জায়গায়। দবির মিয়া শুকনো গলায় বলল, আপনি কী করেন?
কিছু করি না জনাব। সামান্য জমিজিরাত আছে। টুকটাক ব্যবসা আছে।
দবির মিয়া দেখল বরকত আলির মধ্যে একটা সচ্ছল ভাব আছে। গায়ের নীল রঙের পাঞ্জাবিটা বেশ পরিষ্কার। পায়ে স্যাণ্ডেল।
কিসের ব্যবসা আপনার?
ওষুধের। আমার একটা কানপাকার ওষুধ আছে। চালু ওষুধ।
নিজের আবিষ্কার?
জ্বি না, আমার আজানের। হেকিম শরিয়ত আলির।
দবির মিয়া ঈষৎ কৌতূহলী হয়। বাবলুর কানপাকার ঝামেলা আছে। ঠাণ্ডা লাগলেই তার কান দিয়ে পুঁজ পড়ে।
ওষুধ কি রকম?
ভালো ওষুধ, খুব চালু।
বরকত আলি তার চামড়ার ব্যাগ খুলে ফেলল। ব্যাগভর্তি ছোছোট শিশি। শিশিতে সবুজাভ একটি তরল পদার্থ। সঙ্গে ছাপান হ্যাণ্ডবিল আছেঃ শরিয়ত আলির স্বপ্নপ্রাপ্ত কর্ণশুদ্ধি আরক।