মেয়েটি হাসিমুখে চা বানিয়ে আনল। রাগ করে (কপট রাগ) বলল, চা খাওয়াটা কমাও। বড়ো বেশি চা খাও তুমি, ভালো না। এই গরমে কেউ চা খায়। আমি তো সেদ্ধ হয়ে গেলাম।
সাইফুল ইসলাম রহস্য করে বলল, বেশি গরম লাগলে কাপড় খুলে ফেললেই হয়, হা হা হা।
ছিঃ, কী অসভ্যতা যে কর! ভাল্লাগে না।
অসভ্যতা কী করলাম, কেউ তো দেখতে আসছে না।
মেয়েটি তখন সত্যি রাগ করে ঘুমাতে গেল। সাইফুল ইসলাম চা শেষ করে মশারির ভেতর ঢুকে দেখে মেয়েটি কাপড়চোপড় খুলেই শুয়েছে। গত দু-তিন রাত সে এই জাতীয় কিছুই ভাবতে পারছে না। বারবার থানার পাশ দিয়ে আসবার সময় শোনা বীভৎস চিৎকার মনে আসছে। চিৎকার যে এত কুৎসিত হয়, কে জানত!
তার জানতে ইচ্ছা করে চিৎকারটা দিয়েই লোকটা মরল কিনা। লেকটা অবশ্যি মস্ত চোর ছিল। বাজারের চুরিগুলো সেই করিয়েছে। দবির মিয়া বলেছে, তার জিনিসপত্র কিছু কিছু পুলিশ উদ্ধার করেছে। চোর-ডাকাত যত কমে ততই ভালো। থানায় দু-একটা চোর-ডাকাত মারা পড়ার ভালো দিক আছে। চোর-ডাকাত সতর্ক হয়ে যায়। ওসি সাহেব খুব কড়া লোক, এইটা প্রচার হয়। কিন্তু তবু সাইফুল ইসলাম চিৎকারটার কথা ভুলতে পারে না। সে এক রাত্রে হাতের লেখাটা অন্যরকম করে নীলগঞ্জ থানার ওসি সাহেবকে একটা সুদীর্ঘ চিঠি লিখে ফেলে। চিঠির বক্তব্য হচ্ছে, মানুষকে পিটিয়ে মারা অত্যন্ত গৰ্হিত কাজ। তার জন্য তাকে অবশ্যই শাস্তি ভোগ করতে হবে ইত্যাদি। চিঠির শেষে নাম লেখে জনৈক পথিক।
চিঠিটা সে অবশ্যি পাঠানর জন্যে লেখে নি। এ রকম চিঠি সে তার ছাত্রীদের প্রায়ই লেখে এবং কখনো পাঠায় না। কারণ সুদীর্ঘ সেই সব চিঠির প্রায় সবটাই সীমাহীন অশ্লীলতা। পাঠানর প্রশ্নই ওঠে না। ওসি সাহেবের চিঠিতেও খানিকটা অশ্লীলতা ছিল। দ্বিতীয় পৃষ্ঠায় সে লিখেছে কি করে ওসি সাহেবকে খুশি করা হবে এবং বিচি দুটি ফেলে দিয়ে রসুনের কোয়া ভরে দেওয়া হবে।
না পাঠানর জন্যে লেখা হলেও শেষ পর্যন্ত চিঠিটা পাঠিয়ে দিল। অনিদ্ৰা নোগটা তার খুব বাড়ল তার পরপরই। থানার পাশ দিয়ে সে হাঁটা ছেড়ে দিল।
পঞ্চম দিনে ওসি সাহেব লোক পাঠিয়ে তাকে ডেকে নিয়ে গেলেন। এবং অত্যন্ত গম্ভীর মুখে বললেন, কি, আপনাকে তো আজকাল দেখিই না?
সাইফুল ইসলাম ঢোক গিলল।
তা আছেন কেমন?
জ্বি, ভালে।
এসপি সাহেব আসছেন ময়মনসিংহ থেকে। একটা আসামী যে মারা গেছে। সেই তদন্তে।
সাইফুল ইসলাম ছাইবর্ণ হয়ে গেল।
এসপি সাহেব আবার গান-বাজনার খুব সমঝদার। একটু গান-বাজনার ব্যবস্থা করতে পারবেন?
জ্বি জ্বি, তা তা…
দেখেন যদি পারেন। এই শহরে আপনি ছাড়া আর কেউ তো নেই। এই, একে চা-মিষ্টি দে।
হঠাৎ বৃষ্টি
মাঝরাত্রে হঠাৎ করে বৃষ্টি নামল। জহুর বিছানা টেনেটুনে এক পাশে নিয়ে এল। তাতেও শেষরক্ষা হল না। তোষকের অনেকখানি ভিজে চুপসে গেল। মশারি উড়তে লাগল নৌকার পালের মত। বাড়ির লোকজনদের না জাগিয়ে ভেতরে ঢোকার উপায় নেই। জহুরের কাউকে ডাকতে ইচ্ছে হচ্ছিল না। যেরকম বাতাস হচ্ছে, এমনিতেই কারো-না-কারো ঘুম ভাঙবে।
ঘুম অবশ্যি ভাল না। জহুর পা গুটিয়ে বেঞ্চির উপর বসে বৃষ্টি দেখতে লাগল। তার সিগারেট রাবার ইচ্ছা করছিল। হঠাৎ ঘুম ভেঙে গেলে আগুনের স্পর্শের জন্যে মন কাঁদে। সিগারেট নেই, শেষ সিগারেটটি ঘুমাবার আগে ধরিয়েছে। এরকম একটি ঝড়-বাদলের রাত একা-একা জেগে কাটান কষ্টকর। জহুরের শীত লাগছিল। গায়ে দেবার কিছু নেই। চারটি ভিজে ন্যাতান্যাতা।
মামা।
জহুর চমকে উঠে দেখল কোনো রকম শব্দ না করে অঞ্জু দরজা খুলে বারান্দায় এসে দাঁড়িয়েছে। বাতাসে তার লম্বা চুল উড়ছে। অজুর চুল যে এত লম্বা, সে আগে লক্ষ করে নি। জহুর বলল, ভালো বর্ষণ শুরু হয়েছে, দেখলি?
তুমি ডাকলে না কেন আমাদের?
তোরা নিজে থেকে উঠবি, তাই ভেবে ডাকি নি।
অঞ্জু ভারি স্বরে বলল, তুমি এমন ভাব কর, যেন তুমি বেড়াতে এসেছ আমাদের এখানে।
জহুর জবাব দিল না। অঞ্জু বলল, ছোটমার সঙ্গেও তুমি বেশি কথা বল না। শুধু হাঁ-হুঁ কর। ছোটমার ধারণা তুমি তাকে দেখতে পার না।
দেখতে পারব না কেন?
অঞ্জু বেঞ্চির এক পাশে বসল। জহুর বলল, বসলি কেন? ঘুমাতে যা।
তোমার সঙ্গে বসে বসে একটু বৃষ্টি দেখি।
ঘরের ভেতরে বাবলু জেগে উঠে চেঁচাতে শুরু করেছে। দবির মিয়া চাপা গলায় কী একটা বলল। বাবলুর চিৎকার আরো তীক্ষ্ণ ও তীব্র হল। প্ৰচণ্ড একটা চড় কল দবির মিয়া। মুহূর্তে সব চিৎকার-চেঁচামেচি থেমে গেল। শুনশান নীরবতা। জহুর বলল, ঘুমাতে যা।
আরেকটু বসি।
দুলাভাইয়ের সিগারেটের প্যাকেট থেকে একটা সিগারেট এনে দে।
অঞ্জু উঠে চলে গেল। সিগারেট নিয়ে চলে এল সঙ্গে সঙ্গে। তার পিছে পিছে এল বাবলু। জহুর অবাক হয়ে বলল, কি রে বাবলু? কী হয়েছে?
ঘুম আসে না, ভয় লাগে।
ভয়ের কী আছে?
বাবলু উত্তর না দিয়ে বয়স্ক লোকের মতত গম্ভীর হয়ে বসল বেঞ্চিতে। জহুর হাসিমুখে বলল, বাবলু, বৃষ্টিতে ভিজে যাবি।
বাবলু সে কথার উত্তর দিল না। সে খুবই স্বল্পভাষী।
অঞ্জু বলল, টুনী আপার বিয়েটা ভেঙে গেছে, তুমি শুনেছ নাকি মামা?
না তো! কী জন্যে ভাঙল?
তা জানি না। বাবা তো কাউকে কিছু বলে না।
বৃষ্টির বেগ খুবই বাড়ল। জহুর দেখল, বাবলু ঠেস দিয়ে ঘুমিয়ে পড়েছে। অঞ্জু ছোট নিঃশ্বাস ফেলে বলল, মেয়ে হয়ে জলে খুব মুশকিল।