জ্বি-না, চা খাব না।
আরে ভাই খান। ওসি সাহেব আপনাকে ডাকবার জন্যে লোক পাঠিয়েছিলেন। এসে ভালোই করেছেন।
ডেডবডির ব্যাপারে খোঁজ নিতে আসলাম। ওসি সাহেব সকালে আসতে বলেছিলেন।
ডেডবডি তো রাতেই সুরতহালের জন্য পাঠান হয়েছে।
দবির মিয়া কিছু বলল না। সেকেণ্ড অফিসার বললেন, বুঝলেন ভাই, রাত্রে ঘুমাচ্ছিলাম। যখন বলল মনসুর কেমন-কেমন করে যেন শ্বাস নিচ্ছে, তখনই বুঝলাম অবস্থা খারাপ।
ডাক্তার ডাকিয়েছিলেন?
আরে, ডাক্তার ডাকব না? বলেন কি আপনি। পুলিশের চাকরি করি বলেই কি অমানুষ হয়ে গেলাম নাকি ওসি সাহেব নিজে গিয়ে দুধ গরম করে আনলেন।
ডাক্তার এসেছিল?
বললাম তো তাই এসেছিল। আর আপনি যা ভাবছেন, পিটিয়ে মেরে ফেলেছি। আমরা, সেটাও ঠিক না। মারধোর হয়, কিন্তু মানুষ মেরে ফেলবার মতো মারধোর কি করা যায় নাকি? থানা কম্পাউণ্ডের মধ্যে ফ্যামিলি নিয়ে থাকি। ছেলেপুলে আছে। এর মধ্যে এরকম একটা কাণ্ড কি করা যায়? আপনিই বলেন।
তাহলে লোকটা মরল কীভাবে?
ভয়ে। স্রেফ ভয়ে, আর কিছু না। এখন যদি পাবলিক হৈ-চৈ শুরু করে, তাহলেই মুশকিল। পুলিশ সম্পর্কে পাবলিকের ধারণা খারাপ। এই যে মুক্তিযুদ্ধে এতগুলো পুলিশ আমরা মারা গেলাম–কেউ মনে রাখছে সে-কথা, বলেন? মিলিটারি অফিসার যে কজন মারা গেছে পুলিশ অফিসার মারা গেছে তার চার গুণ। সেই সব কথা আর কারো মনে নেই। ঠিক বলেছি কিনা বলেন?
দবির মিয়া জবাব দিল না।
এই জন্যেই ওসি সাহেব আপনাকে খবর পাঠিয়েছেন, পাবলিক যাতে হৈ-চৈ শুরু না করে।
আমার এইখানে কী করার আছে? কী বলছেন এই সব
সেকেণ্ড অফিসার হাসিমুখে বললেন, আপনি বলবেন মনসুর মিয়া চুরির মধ্যে ছিল। তার জন্যেই চুরি হচ্ছিল এত দিন।
কী বলছেন এই সব? চোর-ডাকাতের জন্যে মানুষের কোনো সিমপ্যাথি নেই। চোর-ডাকাত শেষ হলেই পাবলিক খুশি।
আমি একটা নিরপরাধ মানুষকে চোর বাবা
নিরপরাধ, বুঝলেন কী করে? ব্যাটা শুধু চুরি না, ডাকাতির মধ্যেও ছিল। প্রমাণ আছে রে ভাই। বিনা প্রমাণে তো বলছি না। মারাত্মক শয়তান পোক, এত দিন টের পান নি।
দবির মিয়া অবাক হয়ে তাকিয়ে রইল। সেকেণ্ড অফিসার সাহেব বললেন, চা খান, ঠাণ্ডা হচ্ছে। চিনি ঠিক হয়েছে কিনা দেখেন তো। এরা চিনি দিয়ে একেবারে সরবত বানিয়ে রাখে। এককাপ চায়ে এক পোয়া চিনি দেয়। মনে করে মিষ্টি দিলেই চা ভালো হয়।
রাতে ভালো ঘুম হয় না
সাইফুল ইসলামের রাতে ভালো ঘুম হয় না।
তার ঘরটি ছোট। একটিমাত্র জানালা, তাও বন্ধ করে রাখতে হয়। কারণ জানালার ওপাশে মুন্সি সাহেব গরুর গোবর পাবার ব্যবস্থা করেছেন। জানালা ভোলা থাকলে পচা গোবরের গন্ধ বুকের ওপর চাপ হয়ে থাকে। সাইফুল ইসলাম বন্ধ ঘরের গরমে হাঁসফাঁস করে। অর্ধেক রাত পর্যন্ত তালপাতার পাখায় হাওয়া খায়। দু-তিন বার বাইরের মাঠের একটা পরিষ্কার জায়গা দেখে বসে থাকে। বসে থাকতে থাকতে যখন ঘুমে চোখ প্রায় বন্ধ হয়ে যায়, তখন শুতে যায়। প্রচণ্ড ভ্যাপসা গরমে ঘুম চটে যায়। তালপাখা দত নাড়াতে নাড়াতে ভাবে–এই জায়গায় থাকা যায় না। খোলামেলা একটা জায়গা নিতে হবে।
অবশ্যি সে সম্ভাবনা ক্ষীণ। মুন্সি সাহেবের এই ঘরটায় সে বিনা ভাড়ায় থাকতে পারে। তার বদলে মুন্সি সাহেবের একটি নাতিকে পড়াতে হয়। নাতিটির নাম বজলুর রশিদ। পড়াশোনায় কোনোমন নেই। কিছু বললেই বিকট সুরে চিৎকার করে। সে চিৎকারে আশেপাশে ভূমিকম্প হয়ে যায়। ছেলেটির মা পর্দার আড়াল থেকে চিকন সুরে বলে, কি হয়েছে রে বজলু?
আমারে মারছে।
বজলুর মার চিকন গলা আরো চিকন হয়ে যায়, মাষ্টার সাব, পুলাপান মানুষরে মাইরধোইর কইরেন না।
সাইফুল ইসলাম প্রতিবারই বলে, জ্বি-না, মারি নাই। আরব কেন?
কিন্তু ছেলেটির মা বিশ্বাস করে না। কারণ সে দীর্ঘ সময় পর্দার আড়ালে দাঁড়িয়ে থাকে। পর্দার নিচ দিয়ে তার ফর্সা পা দেখা যায়। এরকম ফর্সা পা সাইফুল ইসলাম আর দেখে নি। ছেলেটি অবশ্যি তার মার মতো হয় নি। শ্যামলা রঙ। দাঁতগুলো বের হয়ে আছে। কে জানে তার মার দাঁতও উচু কিনা। উচু হওয়াই স্বাভাবিক। এমন টকটকে যার গায়ের রঙ, তার কোনো খুঁত না থাকলে হয় না। মেয়েদের সঙ্গে থেকে থেকে সে এই সব জিনিস খুব খুটিয়ে খুঁটিয়ে দেখতে শিখেছে। সে দেখেছে খুব ফর্সা মেয়ের ঠোটের কাছে অস্পষ্ট একটা গোঁফের রেখা থাকে, পায়ের লোমগুলো হয় বড়ো বড়ো। ইঞ্জিনীয়ার সাহেবের এক শালীকে সে গান শেখাত। সে মেয়েটি ছিল অসম্ভব ফর্সা। কিন্তু বড়ো বড়ো কুৎসিত লোম ছিল পায়ে। লোমগুলো লালচে ধরনের। বাদামীও হতে পারে। ভালো মতো লক্ষ করা যায় নি। মেয়েটি ঝট করে শাড়ি টেনে দিয়েছে। মেয়েদের বোধহয় ঘাড়ের কাছে অদৃশ্য এক জোড়া চোখ থাকে। মাথা না ঘুরিয়েও অনেক কিছু টের পায়।
লোম থাকুক আর যাই থাকুক, ফর্সা মেয়েদের সাইফুল ইসলামের বড়ো ভালো লাগে। সার্কেল অফিসার সাহেবের হোট মেয়েটিও ফর্সা। তাকেও সাইফুল ইসলামের ভালো লাগে।
যে-সব রাত্রিতে তার ঘুম আসে না, সে-সব রাত্রিতে সে ধবধবে ফর্সা কোনো একটা মেয়ের কথা চিন্তা করে–যার গায়ের চামড়া অসম্ভব মসৃণ। যেন সেই মেয়েটি পাতলা একটা শাড়ি (হলুদ বা কমলা রঙের) পরে রাতে ঘুমাতে এসেছে। সাইফুল ইসলাম বলল, এত সকাল সকাল ঘুমাও কেন গগা, একটু চা-টা কর না।
চা খেলে তো তোমার ঘুম আসবে না। না আসুক, কর একটু।