আমাদের ভাগ্য ভাল এর মাঝে কেউ এসে পড়েনি। দূরে কার গলার আওয়াজ পেয়ে আমি আর রবিন তাড়াতাড়ি জঙ্গলের ভিতর ঢুকে পড়লাম। দুজন লোক হাঁটতে হাঁটতে চলে গেল। রবিন অনেকগুলো ঢিল জড়ো করে সাহেব বাড়িটার বারান্দায় উচু রেলিংয়ের পাশে বসে রইল। আমি একটু এগিয়ে লক্ষ্য করতে থাকলাম কাসেমকে দেখা যায় কিনা।
সলিল যখন পিঁপড়ের কামড় খেয়ে অতিষ্ঠ হয়ে উঠল, হীরার দুহাত যখন টন টন করতে থাকল তখন শোনা গেল কাসেম আসছে। আমাদের হিসেবে ভুল করে দিয়ে সাথে ঠাকুরপাড়ার একটা ছেলে, গলা শুনে বুঝতে পারলাম আক্কাস, ঠাকুরপাড়ার ফুটবল টীমের ক্যাপ্টেন। একজনকে ভয় দেখানো যত সহজ দুজনকে দেখানো তত নয়। তবু আমরা হাল ছাড়লাম না। ওরা একটু কাছাকাছি আসতেই রবিন দুটো ঢিল ছুঁড়ল। ঢিল দুটো পড়ল ওদের পিছনে বেশ শব্দ করে।
ও কি? কাসেম ভয় পেয়ে চেঁচিয়ে উঠল।
কি জানি। আক্কাসের গলার স্বরে ভয়। আমার হাসিতে পেট ফেটে যেতে চাইল। ঢিল দুটো পিছনে পড়েছে তাই ওরা পিছনে যেতে সাহস পাচ্ছে না। আস্তে আস্তে এগুতে লাগল। অমনি রবিন বাকি মাটির হাঁড়িটার ভিতর মুখ ঢুকিয়ে নাক চেপে বিদঘুটে আওয়াজ করল, ঘ্রাঁ ঘোঁ ওঁ ওঁ ওঁ…।
লাইলাহা ইল্লাল্লাহু … কাসেম তোতলাতে থাকে।
আক্কাস ফিসফিস করে বলল, কাসেম তাড়াতাড়ি চল। জায়গাটা খারাপ।
অমনি রবিন নাক চেপে, মাটির হাঁড়ি মুখে নিয়ে উৎকট স্বরে সুর করে বলতে থাকে,
ঘ্রাঁ ঘোঁ ঘ্রাঁ ঘোঁ নাকঁ কাঁটা পেঁট ফুঁটো হাঁদা
ভিঁন পাড়াঁতে ঘুঁরিস কেঁন কাঁসেম হাঁরামাজাঁদা
নাঁক খসবেঁ চোঁখ ফুলবেঁ কিকঁকিড় মিঁককিড় ধাঁ
রক্তঁ দিঁয়ে চুষেঁ খাব ঘাড় কলঁজে পাঁ …।
ইয়াল্লা— কাসেম আর্তনাদ করে ওঠে। লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ….
আমি এদিকে সেদিকে তিন চারটা ঢিল মারলাম। ওরা ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে দাঁড়াতেই দুটো ঢিল মারলাম পিছনে। ওরা আবার দৌড়াতে থাকে। সলিলের গাছের নিচে আসতেই ঝরঝর করে সলিল পানিটা ঢেলে দেয়।
আক্কাস চেঁচিয়ে ওঠে, কে যেন– কে যেন আমার গায়ে পেশাব করে দিয়েছে
আমি বুঝতে পারলাম রবিন বোতলে সাধারণ পানি দেয়নি। কাসেমের গলার স্বর বিকৃত হয়ে গেছে। শুনলাম ও বলছে দৌড় দে– দৌড় দে—
ঠিক এই সময়ে ওরা হীরাকে দেখতে পেল। লম্বা মিশমিশে কালো, দাঁত বের করা বীভৎস মূর্তি খুব আস্তে আস্তে হেঁটে রাস্তা পার হচ্ছে।
কে? কে? বলে কাসেম মিছেই ভাঙা গলায় চেঁচাল।
রবিন কাছাকাছি এসে আবার উৎকট স্বরে শুরু করল,
ঘ্রাঁ ঘোঁ ঘ্রাঁ ঘোঁ নাঁক কাঁটা পেঁট ফুঁটো হাঁদা।
ভিঁন পাড়াঁতে ঘুঁরিস কেন কাঁসেম হাঁরামজাঁদা …
ঠিক সেই মুহূর্তে একটা কেলেঙ্কারি হয়ে গেল। কাসেম আঁ আঁ করে চেঁচাতে চেঁচাতে হীরাকে জাপটে ধরে গোঁ গোঁ করতে লাগল। আমার মনে হল ফিট হয়ে গেছে। হীরা ঘাবড়ে গিয়ে মুখোশ খুলে চেঁচিয়ে উঠল, ছাড়, ছাড় বলছি, আমি হীরা!
কে শোনে কার কথা! কাসেম তখন ভয়ের শেষসীমায় পৌঁছে সব রকম কাণ্ডজ্ঞান হারিয়েছে। আমরা সবাই ছুটে এলাম সলিলও গাছ থেকে নেমে এল। আমরা যে ওকে ভয় দেখিয়েছি ভূতটা যে হীরা, কাসেম সেসব কিছুই বুঝতে পারছিল না। কি রকম একটা শব্দ করে থর থর করে কাঁপছিল। আমার ভয় হতে লাগল, মরেই যাবে নাকি?
আক্কাস প্রথমে আমাদের খুব বিশ্রী করে গালি দিল। কাসেমের এ অবস্থা না হলে হয়ত মেরেই বসত। কাসেম খানিকক্ষণ পর একটু ধাতস্থ হয়ে আমাদের দিকে চোখ পাকিয়ে তাকাল। আমরা কি করব বুঝতে না পেরে বোকার মত হাসতে লাগলাম। আক্কাস আরেকবার গালিগালাজ শুরু করতেই রবিন ধমকে উঠে বলল, থাম তো। তুইই বললি ভয় দেখাতে, আবার এখন নিজেই–
আমি? আক্কাসের চোখ কপালে উঠে গেল!
রবিন আমাকে একটা ইঙ্গিতপূর্ণ খোঁচা দেয়, দ্যাখ দ্যাখ কি রকম অ্যাকটিং করছে!
আক্কাস মুখ চোখ লাল করে বলল, মিছে কথা বলবি না।
রবিন ভীষণ সরলভাবে বলল বাঃ! আমরা কাসেমকে শুধু শুধু ভয় দেখাব কেন? তুইই তো সেদিন বললি, কাসেম নাকি ভীতু ওকে ভয় দেখিয়ে মজা পাওয়া যায়!
এক চড়ে দাঁত ভেঙে ফেলব। আক্কাস তোতলাতে থাকে।
দ্যাখ রবিনও ভীষণ ক্রুদ্ধ হয়ে ওঠে। কাউকে বলতে নিষেধ করে তুই কবিতাটা পর্যন্ত লিখে দিলি। মাটির হাঁড়ি জোগাড় করে দিলি। আমাদের বললি আজ যেভাবে হোক কাসেমকে নিয়ে আসবি।
আক্কাস এইরকম আক্রমণে একেবারে হতবাক হয়ে পড়ে। আমরাও তখন শুরু করলাম,
আমি বললাম, কাজ নেই কাসেম ভয় পেতে পারে, তুই বললি ভীতু ছেলেকেই তো ভয় দেখাতে মজা!
কাসেম কখনো ভীতু নয়- হীরা বলল, সেবার মিউনিসিপ্যাল স্কুলের সাথে মারামারি করেছে না?
তাই তো! সলিলও খুব অবাক হবার ভান করে, আক্কাস কেন যে ভীতু ভীতু করছিল বুঝতে পারছিলাম না।
আমরা সবাই কাসেমের কাছে মাফ চেয়ে নিলাম। আক্কাসের বুদ্ধি অনুযায়ী এটা যে করা উচিত হয়নি রবিন বারবার সেটা স্বীকার করল।
পরদিন প্রকাশ্যে স্কুলের মাঠে কাসেম আর আক্কাসের মারামারি হয়ে গেল। হেডস্যার দুজনকেই পিটিয়ে দিলেন। সেদিন বিকেলেই কাসেম আক্কাসের টীমে লাথি মেরে আমাদের টীমে চলে আসল! কৃতজ্ঞতা বশতঃ হীরা ওকে ভাইস ক্যাপ্টেনের পদটা ছেড়ে দিল।
০৫. খেলা
আমাদের স্পুটনিক বয়েজ ক্লাব তখন ভীষণ তুখোড় হয়ে উঠেছে, বিশেষ করে কাসেম চলে আসার পর। বেশ কিছুদিন চলে যাবার পর আমরা কাসেমকে ভূতের ব্যাপারটা সম্পূর্ণ খুলে বলেছিলাম, কিন্তু ততদিনে সে আমাদের ডিটেকটিভ ক্লাবের মেম্বার, ব্ল্যাক মার্ডারের রক্ত শপথ করা সদস্য, স্পুটনিক বয়েজ ক্লাবের ভাইস ক্যাপ্টেন! কাজেই ওর আমাদের টিম ছেড়ে চলে যাবার কোন প্রশ্নই ওঠে না। বরং ও সবকিছু শুনে ভারি মজা পেল। হাজার হলেও শুধু ওকে দলে টানার জন্যে আমরা এতটা করেছি। ও নিজে ভয় পেয়েছে বলে তার বিশেষ লজ্জা নেই, আক্কাসকে জব্দ করেছি বলেই খুশি!