- বইয়ের নামঃ হাতকাটা রবিন
- লেখকের নামঃ মুহম্মদ জাফর ইকবাল
- প্রকাশনাঃ মাওলা ব্রাদার্স
- বিভাগসমূহঃ উপন্যাস
০১. নতুন ভাড়াটে
হাতকাটা রবিন – মুহম্মদ জাফর ইকবাল
ভূমিকা
তোমরা কেউ যদি আমাকে জিজ্ঞেস কর আমার সবচেয়ে বড় দুঃখ কি, আমি কি বলব জান? আমি বলব, আমার সবচেয়ে বড় দুঃখ যে আমি বড় হয়ে গেছি! আমার চমৎকার শৈশবটি আমার হাতছাড়া হয়ে গেছে, আর কখনো আমি সেটা ফিরে পাব না।
কিন্তু মজার ব্যাপার হল আমি যখন তোমাদের জন্যে লিখি হঠাৎ হঠাৎ আমার সেই হারিয়ে যাওয়া কৈশোর এসে আমার কাছে ধরা দেয়! মনে হয় আবার আমি ছোট হয়ে গেছি, তখন আমি উপন্যাসের চরিত্রদের সাথে মাঠে-ঘাটে, বনে-জংগলে ঘুরে বেড়াই, বিচিত্র সব এডভেঞ্চারে অংশ নিই, আর আমার বুকের ভিতরে আশ্চর্য এক ধরনের আনন্দ হতে থাকে।
এই বইয়ের উপন্যাসগুলি পড়ে তোমরা যদি আমার সেই আনন্দটুকু একটুখানিও অনুভব করতে পার আমার আর কিছু চাইবার নেই।
মুহম্মদ জাফর ইকবাল
পল্লবী, ঢাকা
.
০১. নতুন ভাড়াটে
আমাদের পাশের বাসাটা অনেকদিন খালি পড়ে ছিল। গতরাতে নতুন ভাড়াটে এসেছে। আগে এখানে মাসুদরা থাকত। মাসুদ ছিল আমাদের এক নাম্বারের বন্ধু। তাই মাসুদের আব্বা বদলি হয়ে চলে গেলে আমরা সবাই মনমরা হয়ে কয়েকদিন ঘুরোঘুরি করেছিলাম। তারপর আমাদের হাসপাতালটা উঠে গেল। (সে যে কি দারুণ একটা হাসপাতাল আমাদের ছিল!) আমাদের হাসপাতালে মাসুদ ডাক্তার, ওর আব্বা ডাক্তার কিনা, আর আমরা সবাই নার্স। মাসুদরা চলে গেলে ডাক্তারের অভাব হয়ে গেল। তাই হাসপাতালটাও উঠে গেল। আমরা কেউ বুঝতে পারিনি যে মাসুদ চলে যাবে তাহলে না হয় আমরা কেউ ডাক্তারিটা শিখে নিতাম– ওটা এমন কিছু কঠিন নয়।
মাসুদরা চলে গেলে ওই বাসায় যারা এসেছিল তাদের আব্বাও ডাক্তার। এটা সরকারী ডাক্তারের বাসা আর এখানে সবসময় ডাক্তার আসেন। আমরা ভাবলাম এ ছেলেটা হয়তো আমাদের ডাক্তার হবে, আমরা হাসপাতালটা আবার চালু করব। কিন্তু ছেলেটা মোটেই আমাদের সাথে কথা বলল না। বোনদের নিয়ে বারান্দায় বসে লুডু খেলত। আমাদের ফুটবল টিমে একজন কম পড়েছিল বলে তাকে কত ডাকলাম তা সে কিছুতেই এল না। ওদের একটা গাড়ি ছিল সেটাতে করে ঘুরে বেড়াত আর আমাদের দিকে এমনভাবে তাকাত যেন আমরা রাস্তার ‘ছোঁড়া’! হীরা ঠিক করেছিল ওর মাথায় একদিন ঢিল মারবে, মেরেছিল কিনা কে জানে! ওটা যা পাজি! পরে আমাদের দেখলেই ওই ছেলেটা ঘরের ভিতরে চলে যেত। ওরা চলে গেলে আমরা সবাই খুব খুশি হয়েছিলাম।
আমি দেখেছি একবার কোনো বাসায় বন্ধু থাকলে, এর পরে যে আসে সে শত্রু হয়। এরপর আবার বন্ধু আসে। আমি নান্টু, হীরা, সলিল, মিশু ওদেরকেও এটা বলেছি, ওরা সবাই আমার কথা স্বীকার করেছে। মিশুরা যখন ঢাকায় থাকত তখন নাকি এটা ওর এমন অভ্যাস হয়ে গিয়েছিল যে ওর বন্ধুরা চলে গেলে সে বাসায় যাবা আসত তাদের সাথে সে কথাই বলত না, কারণ এ তো জানা কথা তারা ওর শত্রু হবে। এরপর শত্রুরা চলে গিয়ে আর কেউ আসলে ও আবার বন্ধু তৈরি করত। এটা নাকি ওর ভীষণ অভ্যাস হয়ে গিয়েছিল।
কাল রাতে যখন মাসুদদের বাসায় নতুন ভাড়াটে আসল তখনই আমি বুঝতে পেরেছিলাম এবারে একজন বন্ধু পাব। আমি জানালা দিয়ে তাকিয়ে ছিলাম– একটা ছেলেকে আবছা আবছা দেখেছি। আমি ঠিক জানি ও আমাদের বন্ধু হবে। তাই সকালবেলা আমরা ওই বাসার সামনে ঘুরোঘুরি করছিলাম। তারপর আমরা বাসার সামনে বড় পেয়ারা গাছটাতে পা দুলিয়ে বসে থাকলাম। গাছটায় একটাও বড় পেয়ারা নেই সব খেয়ে ফেলেছে। মাঝে মাঝে পাতার আড়ালে হঠাৎ করে বড় পেয়ারা পেয়ে গেলে আমরা সবাইকে এক কামড় করে খেতে দিই। হীরাটার কথা অবিশ্যি আলাদা, ও পেলে একলাই খায়।
অনেকক্ষণ ওই বাসাটার দিকে তাকিয়ে থাকার পর হঠাৎ আমাদের বয়সী একটা ছেলে তিন লাফে বেরিয়ে এল, তারপর আবার ঢুকে গেল। খানিকক্ষণ পর ছেলেটা একটা শার্টের বোতাম লাগাতে লাগাতে আবার বেরিয়ে এল। ওকে দেখে আমরা এত অবাক হলাম যে গাছ থেকে নেমে ওকে ডাকার কথা ভুলে গেলাম। আমাদের সমানই হবে ছেলেটা, কাল হাফপ্যান্ট আর লাল ফুলশার্ট পরনে। শাটটার বাম হাতটা কনুইয়ের পর গিঁট মেরে ঝুলিয়ে রেখেছে–ওর হাতটা ওখান থেকে কাটা।
ছেলেটা এদিক সেদিক তাকাল তারপর আমাদের গাছে বসে থাকতে দেখে হেঁটে হেঁটে গাছটার নিচে এসে দাঁড়াল, এক হাতে তরতর করে কি ভাবে জানি গাছটাতে উঠে মুখ কুঁচকে বলল, তোরা সব এ পড়ার ছেলে? হ্যাঁ?
বিশ্বাস হতে চায় না, পরিচয় নেই কথাবার্তা নেই অথচ প্রথমেই ঠিক এই কথাটা বলল? আমরা ভীষণ অবাক হলাম। রাগ হলাম আরও বেশি। হীরা বলল, খবরদার, তুই তুই করে কথা বলবি না।
তুইও তো তুই তুই করে বললি! বলে ছেলেটা ফ্যাকফাক করে হেসে ফেলল। তারপর বলল, তোরা নিজেরা তুই তুই করে বলিস না?
হুঁ। আমি মাথা নাড়লাম। বলি তো কি হয়েছে?
আমি বললে দোষ কি? আমিও তো এখানে থাকব।
ওর যুক্তিটা আমরা ফেলতে পারলাম না। বলতে কি উত্তরে বলার মত কিছু পেলামও না। তাই বলে খুব খুশি মনে যে ওকে স্বীকার করে নিলাম তা নয়। নেহায়েত হাতটা কাটা তাই একটু কৌতূহল হচ্ছিল। আমি জিজ্ঞেস করলাম, তোমার হাত কেটেছে কেমন করে?