আমি ফিরে এসে সবাইকে বললাম আগামী কাল বিকেলেই ঠাকুরপাড়ার টীমের সাথে খেলা। শুনে সবাই ভারি উত্তেজিত হয় পড়ল। আমি বললাম, এটা কিন্তু সত্যিকারের খেলা না –
তবে?
এমনি খেলা হবে। কাল দেখব ওরা কি রকম খেলে। তারপর পরে আসল কম্পিটিশান হবে।
ওরা সবাই আমার বুদ্ধির প্রশংসা করল। আমরা ঠিক করলাম কাল প্রথমে আমরা খেলতে রাজি হব না। পরে নিমরাজি হয়ে খেলব আর এমন ভাব দেখব যে খুব তাচ্ছিল্য করে খেলছি। একজন করে খেলা বন্ধ করে বসে থাকব, নিজেরাই নিজেদের একটা গোলও দিয়ে দেব। তাহলে হেরে গেলেও গায়ে খুব বেশি লাগবে না। ওরাও খুব বেশি ঠাট্টা করতে পারবে না।
পরদিন খেলার মাঠে ওরা হাজির হল। এমনি খেলা হচ্ছে বলার পরেও ওদের পাড়ার অনেক ছেলে খেলা দেখতে এসেছে। আমরা নিমরাজি ভাব দেখিয়ে উদাসীন ভাবে খেলতে লাগলাম। দেখি ঠাকুরপাড়ার টীমে আমাদের পাড়ার একটা ছেলে খেলতে নেমেছে। হীরা বলল, তুই ঠাকুরপাড়ার টীমে খেলছিস কেন? তুই না আমাদের পাড়ার?
ছেলেটা নাম কাসেম তাচ্ছিল্য ভরে ঠোঁট উল্টে বলল, ইচ্ছে!
আমরা হৈ হৈ করে আপত্তি তুললাম, আমাদের পাড়ার ছেলে অন্য পাড়ার টীমে খেলতে পারবে না।
ওরা বলল, কাসেম, যদি আমাদের টীমে খেলতে রাজি হয় তাহলে ওদের কোন আপত্তি নেই। কিন্তু ওদের দলে ছেলে কম কাজেই এখন সে তাদের টীমেই খেলবে। কাসেম যে ঠাকুরপাড়ার টিম ছাড়া অন্য কোন টীমে খেলবে না সে তো জানা কথা। তার বাসাটাই শুধু এ পাড়ায়, চলাফেরা খাওয়া-দাওয়া বন্ধুত্ব সব ঠাকুরপাড়ার ছেলেদের সাথে।
শেষ পর্যন্ত কাসেমকে ওদের সাথে খেলতে দিতে হল। খেলায় আমরা পরিষ্কার ভাবে হেরে গেলাম। চারটে গোল খেয়েছি, একটি মাত্র দিয়েছি। বহু কষ্ট করে প্রাণপণ খেলেও এর বেশি একটা গোলও দেয়া গেল না। ওরা টিটকারি দিতে দিতে চলে গেলে আমরা খালি গায়ে মাঠে বসে ঘাস ছিঁড়তে লাগলাম।
টিমটা ভালই। রবিন অনেকক্ষণ পর একটা মন্তব্য করল।
কাসেম যদি আমাদের টীমে খেলত! হীরা দুঃখ করে বলল, কিন্তু যা বদমাইশ!
বিশ্বাসঘাতক! সলিল বিড়বিড় করে গালি দিল।
কাসেমকে আমাদের টীমে আনা যায় না? রবিনের প্রশ্ন শুনে আমরা একসাথে চেঁচিয়ে উঠলাম, পাগল হলি তুই?
ঠাকুরপাড়া হচ্ছে তার মক্কা মদীনা!
ঠাকুরপাড়ার ছেলেরা হচ্ছে তার প্রাণের বন্ধু!
তবু চেষ্টা করব। রবিন গম্ভীর স্বরে বলল, তোরা দেখিস ওকে ঠিক আমাদের টীমে নিয়ে আসব, তারপর ঠাকুরপাড়ার সাথে ফাইনাল খেলা দেব।
কিভাবে আনবি?
দেখিস তো! রবিন কি যেন ভাবতে লাগল।
কাসেমকে আমাদের টীমে আনতে পারলে অবিশ্যি আমাদের টিমটা বেশ শক্ত হয়। কিন্তু তবু কি জেতা যাবে? ওদের হাবুল আর আক্কাস আমাদের স্কুলের ফুটবল টীমে খেলে, পায়ের গোছ এই চওড়া!
০৪. সাহেব বাড়ির ভূত
কদিন ধরেই দেখছি রবিন কি যেন ভাবছে, আমাদের কিছু বলছে না। বুঝতে পারলাম কাসেমকে দলে টানার প্ল্যান করছে। অনেক করে বলার পরও রবিন আগে থেকে কিছু জানাতে রাজি হল না।
সেদিন রাত আটটার দিকে রবিন আমাদের বাসায় এসে হাজির। আমাকে সোজাসুজি অগ্রাহ্য করে আম্মার কাছে গিয়ে বলল ও একটু বাইরে যাবে আমাকে নিয়ে যেতে চায়। ঘণ্টাখানেকের মাঝেই ফিরে আসবে। আম্মা বহুদিন থেকে আমাদের চেনেন কাজেই কথা না বলে আমায় ডেকে দিলেন। রবিনকে নিয়ে বাইরে এসে দেখি হীরা অন্ধকারে দাঁড়িয়ে আছে, সলিলও আছে। সলিলের হাতে একটা কালো কাপড়ের বাণ্ডিল, হীরার কাছে একটা বড় বোতল, দুটি মাটির হাঁড়ি।
কি ব্যাপার? আমি অবাক হলাম। এসব দিয়ে কি করবি?
আয় না! কাসেমের বারোটা বাজাব।
রবিনের কাছে জানতে পারলাম কাসেম রাতে অংক স্যারের বাসায় অংক করতে যায়। যে পথ দিয়ে ফিরে আসে সেখানে সাহেব বাড়িটা পড়ে। পুরানো দালানের পাশে বেশ খানিকটা জঙ্গল, রাত বিরেতে ওখানে নাকি ভূত দেখা যায়। রবিন অনেক খবর নিয়েছে, রাত সাড়ে আটটার দিকে কাসেম নাকি এই পথ দিয়ে একা ফিরে যায়। রবিন ঠিক করেছে আজ সাহেব বাড়ির পাশে থেকে কাসেমকে ভয় দেখিয়ে দেবে – যেন আর ঠাকুরপাড়ার টীমে না খেলে।
আমার ঠিক বিশ্বাস না হলেও পুরো ব্যাপারটা ভারি মজার মনে হচ্ছিল। সবাই মিলে গুটিগুটি হেঁটে সাহেব বাড়ির পাশে হাজির হলাম। অন্ধকার, জঙ্গল, গাছপালা দেখে আমার বেশ ভয় ভয় করতে লাগল। এরপর রবিন হীরাকে সাজাতে বসল। মাটির হাঁড়িটা হাতে নিয়ে হীরা হাত উঁচু করে দাঁড়াল আর কালো শাড়িটা দিয়ে পেঁচিয়ে পেঁচিয়ে ওকে ঢেকে দেয়া হল। দেখতে হল নাংগা একটা পেত্নীর মত। তারপর রবিন একটা মুখোশ বের করল, ভয়ানক বিচ্ছিরি দেখতে – আমার গা ছমছম করে উঠে। তারপর সেটি ওর উঁচুকরা দু হাতে ধরে রাখা হাঁড়িটার সাথে বেঁধে দেয়া হল।
কাসেম যখন আসতে থাকবে তখন তুই কিছু করবি না। রবিন হীরাকে এর দায়িত্ব বুঝিয়ে দিল, ওখানে দাঁড়িয়ে থাকবি। যখন কাছে আসবে তখন আস্তে আস্তে হেঁটেহেঁটে ওর খুব কাছে দিয়ে রাস্তা পার হয়ে এই জঙ্গলে ঢুকে পড়বি। ব্যাস একটা কথাও বলবি না, একবারও সোজাসুজি ওর দিকে তাকাবি না। বাকি সব আমরা করব।
সলিলকে পানি ভর্তি বোতলটা দিয়ে রবিন ওকে একটা গাছে তুলে দিল। গাছে উঠে বসলে বুঝিয়ে দিল, তোর কাছাকাছি আসতেই বোতলটা কাত করে পানি ঢালতে থাকবি। পারলে ওর শরীরের উপর! সলিল শুনে খিকখিক করে হেসে উঠল।