.
আবার খেলা শুরু হল। দমাদম কিক মারতে লাগলাম, দুদ্দাড় আছড়ে পড়তে লাগলাম, আর বল নিয়ে ছুটোছুটি করতে লাগলাম। রবিন দারুণ খেলে গেল। ওরা আর একটা গোলও দিতে পারল না-– উল্টো আমরা একটা গোল শোধ করে দিলাম।
খেলা শেষ হলে আমরা হাঁপাতে হাঁপাতে বলকে ঘিরে বসে রইলাম। গেঞ্জি খুলে বাতাস করতে করতে সলিল প্রস্তাব দিল, চল গোসল করে আসি।
রবিন জিজ্ঞেস করল, কোত্থেকে?
নদীতে। আমি রবিনকে বুঝিয়ে দিলাম, একটু দূরেই নদী, ঝকঝক করছে পানি। সাঁতার জানিস?
জানতাম।
ভুলে গেছিস? বলে আমরা খিলখিল করে হাসতে লাগলাম সাঁতার কেউ কখনও ভোলে?
দাঁত কিড়মিড় করে রবিন বলল, ভুলিনি, হাত কেটে ফেলার পর আর সাঁতরাইনি। কাটা হাত নিয়ে সাঁতরানো যায়?
আমরা অপ্রস্তুত হলাম! একথাটা আগে চিন্তা করিনি। এই প্রথম দেখা গেল হাত কাটা থাকার কিছু কিছু অসুবিধেও আছে।
বিকেলে গোসল করা ঘোরতর বেআইনী। তাই তোয়ালে সাবান এসব না নিয়ে যে যেভাবে আছি সে ভাবেই আমরা নদী তীরে রওনা দিলাম। ভোঁ ভোঁ করে আমাদের গাড়ি ছুটল, একজনের থেকে আরেকজনের গাড়ির জোর বেশি। হর্নের শব্দে কান পাতা দায়!
ঠাকুরপাড়া শুরু হতেই আমরা ভদ্র হয়ে গেলাম। এদের ফুটবল টিমটা দারুণ। ছেলে গুলোও ভীষণ মারপিট করনেওয়ালা। হীরা দুবার ওদের কাছে মার খেয়েছে।
দেখা গেল ভীষণ চেঁচিয়ে হৈ হল্লা করে ঠাকুরপাড়ার ছেলেরা কিংকুইন খেলছে। আমাদের দেখে দুই হাই করে কয়েকটা চিৎকার দিল। তারপর একজন টেনিস বলটা হাতে নিয়ে সাঁ করে সলিলের ঘাড়ে মেরে বসল।
আমরা তবু চলে এলাম। ভিন্ন পাড়া দিয়ে যেতে হলে একটু অত্যাচার সহ্য করতেই হয়। রবিন সলিলকে বলে, তুই কিছু বললি না? তোকে এভাবে মারল?
আসুক না আমাদের পাড়ায়! সলিল চোখ পাকিয়ে বলল, পুরো ফুটবলটা ওর পিঠে ফাটাব।
.
নদীর তীরে অনেক দূর বালুর চড়া। কিছু কিছু লোকেরা ছেলেমেয়ে নিয়ে বেড়াতে এসেছে, রঙিন কাপড় পরনে হাসিখুশি চেহারার লোক। কয়েকটা নৌকা ছাড়া ছাড়া ভাবে এদিকে সেদিকে বাঁধা আছে। মাঝিরা ভাত চড়িয়ে গলুইয়ে চুপচাপ বসে আছে। আমরা হৈ হৈ করতে করতে ছুটতে ছুটতে কাপড় খুলতে খুলতে নদীর তীরে পৌঁছালাম তারপর ঝপাং করে নদীতে লাফিয়ে পড়লাম। দুটো ডুবে নদীর মাঝামাঝি এসে দেখি রবিন মুখ শক্ত করে তীরে দাঁড়িয়ে আছে। নদীতে নামছে না। আমি চেঁচিয়ে বললাম, নেমে পড়। কিচ্ছু হবে না।
রবিন অন্যমনস্কভাবে মাথা নেড়ে আমাদের দিকে তাকিয়ে রইল। আমার কেন জানি হঠাৎ করে ওর জন্যে ভীষণ মায়া হল। সাঁতরে তীরে এসে ওকে ডাকলাম, রবিন, এখানে নেমে আয় দ্যাখ, মাত্র বুক পানি। তুই নাম কিচ্ছু হবে না। আমরা পাহারা দিচ্ছি।
রবিন ওস্তাদ সাঁতারুর মত পানিতে নেমে এল। বোঝা গেল হাত কাটার আগে ও পানির পোকা ছিল। আমরা সবাই ওকে ঘিরে দাঁড়ালাম, আর সে সাঁতরাতে চেষ্টা করল। দেখা গেল সে এখনও সাঁতরাতে পারে ঠিকই কিন্তু খুব তাড়াতাড়ি দম ফুরিয়ে যায়।
ঠিক হয়ে যাবে। রবিন মুখে হাসি ফুটিয়ে বলল, কয়েকদিন প্র্যাকটিস করলেই সব ঠিক হয়ে যাবে।
.
বাসায় ফেরার সময় আমাদের সবার বুক দুরুদুরু করতে থাকে। ভিজে কাপড়ে বাসায় যাওয়া মানে আম্মার চড় কানমলা আর বকুনি। কাপড় যে খানিকক্ষণ ঘুরে শুকিয়ে নেব, তারও উপায় নেই – অন্ধকার হয়ে আসছে। রাস্তার বাতি এর মাঝে জ্বলে গেছে। রবিনের কিন্তু ওসব কোন দিকে খেয়াল নেই, ও শুধু খবর নিতে লাগল। আশেপাশে কোন্ ফুটবল টিম কতটুকু শক্ত, আমরা যদি ফুটবল ক্লাব খুলি তাহলে সবার সাথে জিততে পারব কি না। একটা ট্রফির দাম কত, ট্রফির খেলা দিলে খেলা কেমন জমবে, এই সব!
তখন দ্রুত সন্ধ্যা হয়ে আসছে আমরা শুকনো মুখে বাসায় ফিরে যেতে লাগলাম। দূর থেকে দেখা যাচ্ছে ঘরে ঘরে আলো জ্বলে গেছে। অর্থাৎ আজ শুধু বেআইনী গোসল করার অপরাধ নয় তার সাথে দেরি করে ফেরার মাশুলও দিতে হবে। আজ আর রক্ষে নেই।
০৩. স্পুটনিক বয়েজ ক্লাব
হড়বড় করে ভাত খাচ্ছিলাম। আম্মা বললেন, সারাদিন কি করিস? ভাতটা পর্যন্ত ধীরে সুস্থে খেতে পারিস না?
একদলা ভাত অর্ধেক চিবিয়ে গিলে ফেলে বললাম, সবাই অপেক্ষা করছে, খেলতে হবে না!
এই মাত্র না আসলি স্কুল থেকে?
আমি আর বৃথা তর্ক করলাম না। এই মাত্র স্কুল থেকে এলে কি খেলতে যাওয়া যায় না? কিন্তু আম্মাকে সেটা কে বোঝাবে?
স্কুলের জামা কাপড় বদলে একটা কালো হাফ প্যান্ট পরে আমি এক ছুটে মাঠে এসে হাজির হলাম। সেখানে কেউ নেই দেখে আমি গেলাম আমাদের ডিটেকটিভ ক্লাবে। সেখানে দেখি ভীষণ ধুমধাড়াক্কার সাথে বল পাম্প করা হচ্ছে। প্রতিদিন টাটকা পাম্প করে নাকি খেলার নিয়ম।
রবিন পাম্প শেষ করে বলল, চল আমরা অন্য পাড়ার সাথে একটা ফুটবল খেলা দিই।
চল! আমরা সবাই এক বাক্যে রাজি হয়ে গেলাম। শুধু সলিল মুখ সূঁচালো করে বলল, কিন্তু ঠাকুরপাড়ার সাথে হেরে যাব।
কখখনো না! রবিন তুড়ি মেরে উড়িয়ে দেয়। আজ থেকে আমরা প্র্যাকটিস শুরু করব।
সত্যি সত্যি প্র্যাকটিস শুরু করা হল। আমার উপর জোর দেয়া হল সবচেয়ে বেশি। ভাল গোলকীপার থাকলে নাকি খেলায় অর্ধেক জেতা হয়ে যায়। ওরা সবাই আমার সামনে থেকে দমাদম কিক মেরে গোল দেয়ার চেষ্টা করছিল আমি লাফিয়ে কুদিয়ে সেগুলি ধরার চেষ্টা করছিলাম। একেকবার একেকটা বল হাতের ফাঁক দিয়ে চলে যাচ্ছিল অমনি সবাই চেঁচিয়ে উঠছিল ‘গো-ও-ল!’ আবার যখনি একটা মারাত্মক বল ধরে ফেলছিলাম তখন ওরা ‘সাবাশ’ ‘সাবাশ’ বলতে দ্বিধা করছিল না।