খেলা শুরু হল। সবাই দমাদম কিক মেরে বলটাকে এ মাথা থেকে ও মাথা পর্যন্ত ছোটাতে লাগল। সলিল আর হীরা মিলে আমাদের দুটো গোল দিয়ে দিল। আমি গোলকীপার। রবিন এসে আমাকে বলল, আরেকবার গোল হলে চোখ কানা করে দেব।
আমিও তেরিয়া হয়ে বললাম, যদি গোল শোধ করতে না পারিস বাকি হাতটাও কেটে নেব। রবিন আমার দিকে চোখ পাকিয়ে বলের পিছে পিছে ছুটল। নান্টুকে বলে কয়ে গোলকীপার তৈরি করে আমি মাঠের মাঝে চলে এলাম। দমাদম কিক মেরে বল কেটে বের করে নিয়ে এসে গোল পোস্টের দিকে এগিয়ে যাচ্ছি, রবিনও জায়গামত আছে এমন সময় হীরা পিছন থেকে এসে আমাকে ল্যাং মেরে ফেলে দিল! বল নিয়ে ছুটে গিয়ে আমাদের আরেকটা গোল দিয়ে দিল। নান্টু গোলকীপার হিসেবে একেবারে যাচ্ছেতাই!
ঘেমে টেমে আমরা অস্থির। একেকজন লাল হয়ে হাঁপাচ্ছি। তিনটি গোল খেয়ে রবিনের চেহারা হয়েছে ভয়ঙ্কর। হীরাকে ধাক্কা দিয়ে ফেলে সলিলকে পাশ কাটিয়ে সে দারুণ ভাবে খেলতে লাগল। গোল পোস্টের কাছে এসে বলটাকে সামলানোর জন্যে তার কাটা হাতটা দিয়ে হঠাৎ করে বলটাকে থামিয়ে নিল, তারপর এক কিকে গোল।
ততক্ষণে সলিল, হীরা ওরা তুমুল হৈ চৈ শুরু করে দিয়েছে। হ্যাণ্ডবল হ্যাণ্ডবল করে চেঁচিয়ে দাপাদাপি শুরু করেছে।
রবিন মুখচোখ লাল করে বলল, হ্যাণ্ড নেই আবার হ্যাণ্ডবল কিসের?
যতটুকু আছে ততটুকুই হ্যাণ্ড।
ইশ! রবিন মুখ খিঁচিয়ে বলে, কনুই পর্যন্ত আছে, ওটাকে আর্ম বলে। ওখানে লাগলে হ্যাণ্ডবল হয় না।
আমি তারস্বরে চেঁচিয়ে রবিনকে সমর্থন করে যেতে লাগলাম। ভাব দেখে মনে হল বিকেলের অর্ধ সমাপ্ত মারামারিটা এবারে ব্যাপক ভাবে শুরু হয়ে যাবে। নান্টু তখন শফিক ভাইয়ের কাছে যাওয়ার বুদ্ধি দিল। কথাটা ঠিক, আমাদের এতক্ষণ মনে হয়নি। আমরা খেলা বন্ধ করে দল বেধে শফিক ভাইয়ের কাছে চললাম। হীরা আর রবিন তখনও ঝগড়া করে যাচ্ছে।
আমাদের সবার, বাসা পাশাপাশি। বাসার সামনে তখন মেয়েরা লুকোচুরি খেলছিল। আমাদের দলটাকে আসতে দেখে ওরা দাঁড়িয়ে গেল। একটু পরে বুঝতে পারলাম ওরা রবিনকে লক্ষ্য করছে। হাতটা কি চমৎকার ভাবে কাটা! আমার হিংসে হতে লাগল।
শফিক ভাই বাগানে দাঁড়িয়ে সিগারেট খাচ্ছিলেন। তার লুকিয়ে সিগারেট খাওয়ার একটা আলাদা জায়গা আছে। আমাদের দেখে বললেন, ব্ল্যাক মার্ডারের খবর কি?
আমাদের এত তীক্ষ্ণ গোপনীয়তার পরেও কিভাবে যে দলের নাম ফাঁস হয়ে গেছে বুঝতে পারলাম না। শফিক ভাইয়ের কথা না শোনার ভান করে আমরা আমাদের সমস্যাটা খুলে বললাম। তিনি রবিনকে খানিকক্ষণ লক্ষ্য করলেন। তারপর বললেন, ঠিক করে বল তো বলটা হঠাৎ এসে লেগেছে না ইচ্ছে করে লাগিয়েছ?
রবিন গাঁই ছুঁই করে পিছে সরে এল। এমন গাধা ছেলে, যখন একটু মিছে কথা বললেই ঝামেলা মিটে যায়, তখন মিছে বললেই হয়। হীরা উল্লাসে চেঁচিয়ে উঠে বলল, ইচ্ছে করে, ইচ্ছে করে লাগিয়েছে।
তাতে কি হয়েছে? রবিন ফোঁস করে উঠল। আমার হাত তো কাটা, বল লাগলে হ্যাণ্ডবল হবে কেন?
কিন্তু তাই বলে তুমি ইচ্ছে করে বল হাত দিয়ে থামাবে? তোমার কাটা হাতের সুযোগ নেয়াটা তো অন্যায়।
শেষ পর্যন্ত দেখা গেল দোষ রবিনের। রবিন ফোঁসফোঁস করে দোষ মেনে নিল। আমরা বল নিয়ে ফিরে যেতে লাগলাম। দেখি মেয়েরা তখনো খেলা বাদ দিয়ে আবার ড্যাব ড্যাব করে তাকিয়ে আছে। সত্যি এমন হাত কাটা ছেলে কয়টা পাওয়া যায়? রবিনের জন্যে তখন আমাদের গর্ব হতে লাগল।
এই ছেলেরা! শুনে যাও– হঠাৎ ডাক শুনে তাকিয়ে দেখি শিরি আপা। আমরা ছুটতে ছুটতে শিরি আপার কাছে হাজির হলাম। রবিন নতুন এসেছে জানে না শিরি আপা ডাক দেয়া মানেই চিনেবাদাম না হয় লজেন্স খাওয়ানোর জন্যে ডাক। তাই সে এল সবার পিছে পিছে হাঁটতে হাঁটতে। কিন্তু দেখা গেল শিরি আপার কৌতূহল রবিনকে নিয়েই।
তোমরা নতুন এসেছে বুঝি?
জ্বী।
নাম কি তোমার?
মোহাম্মদ জাহাঙ্গীর আলম।
আমরা জানিয়ে দিলাম ওর আসল নাম হাকার-বিন ওরফে হাত কাটা রবিন।
কয় ভাইবোন তোমরা?
তিন।
কোন ক্লাসে পড়?
সেভেনে।
দেখা গেল রবিন আমাদের সাথেই ওরকম কাঠ গোঁয়ার, শিরি আপার সামনে দিব্যি ভদ্র ছেলেটি। একটু পরেই শিরি আপা জিজ্ঞেস করলেন, তোমার হাতে কি হয়েছিল?
রবিনকে একটু অসহিষ্ণু দেখা গেল। বলল, কেটে ফেলেছে।
কি ভাবে?
রবিন ঘটনাটা বর্ণনা করল অনেক কম কথায়। কাটা আঙুল দুটি যে টিকটিকির ল্যাজের মত লাফাচ্ছিল ঐ কথাটা পর্যন্ত বাদ দিয়ে গেল।
শিরি আপা শুনে জিহ্বা দিয়ে চুকচুক শব্দ করলেন। রবিন উসখুস করে উঠে আমাদের বলল, চল যাই।
আমরা শিরি আপার লজেন্সের জন্যে অপেক্ষা করছিলাম। দেখা গেল শিরি আপার সে রকম কোন পরিকল্পনা নেই। কেমন করে জানি রবিনের দিকে তাকিয়ে আছেন।
আমরা হৈ হৈ করে বেরিয়ে এলাম। তিন পা যেতে না যেতেই সলিলের আম্মা ডাকলেন, সলিল! তোরা শুনে যা —
আবার রবিনকে জিজ্ঞেস করা হল, তোমার নাম কি? কোন ক্লাসে পড় এই সব। তারপর তোমার হাত কি করে কাটল?
রবিন আবার গড়গড় করে বলে গেল। আহ উহ করার সময় আমরা বেরিয়ে এলাম। কিছুদূর না যেতেই আবার ডাক, এবার নান্টুর বড় ভাই!
.
আমরা নান্টুর ভাইয়ের কাছ থেকে ছাড়া পেয়ে এক ছুটে একেবারে মাঠে হাজির হলাম। এত তাড়াতাড়ি দৌড়ে এসেছি যেন আর কেউ ডাকতে না পারে। রবিন হাঁপাতে হাঁপাতে মুখ খিঁচিয়ে বলল, আমি মোটমাট তিন লক্ষ বার বলেছি হাত কিভাবে কেটেছে! কারো সাথে দেখা হতেই … রবিন কাকে কি যেন একটা গালি দিল।