এক সময় মিশু শিউরে উঠে বলল, ইশ!
ছেলেটা চোখ বড় বড় করে বলল তোরা যদি দেখতি — আমার দুটো আঙুল কেটে মাটিতে পড়ে টিকটিকির ল্যাজের মতো তিড়িং বিড়িং করে লাফাচ্ছিল!
যাঃ!
হ্যাঁ। ছেলেটা জোর দিয়ে বলল। তারপর অনেকদিন স্কুলে যেতে হয়নি। হাসপাতালে ছিলাম। তাতেই এক বছর নষ্ট হয়ে গেল। তোরা কোন ক্লাসে পড়িস?
আমি সেভেনে, নান্টুও সেভেনে, হীরা সিক্স।
ছেলেটা খুশি হল। নিচের ক্লাসে হলে ওর সর্দার হওয়া একটু কঠিন হবে কিনা।
আরও খানিকক্ষণ গল্প করে আমরা বাসায় চলে এলাম। দুপুর হয়ে গিয়েছিল। আসার সময় ছেলেটিকে জিজ্ঞেস করলাম, ডাক নামটা কি?
হাকার-বিন!
মানে?
মানে হাত কাটা রবিন। বলে সে হিঃ হিঃ করে হাসল!
» ০২. হাত কাটা রবিন
আমি বাসায় গিয়ে সবাইকে হাত কাটা রবিনের গল্প বললাম। ছেলেটিকে যে আমার পছন্দ হয়েছে তা গল্প করতে গিয়ে বুঝতে পারলাম। সত্যমিথ্যা এক গাদা জিনিস বলে সবাইকে তাক লাগিয়ে দিলাম। আম্মা বললেন, নিয়ে আসিস তো ছেলেটাকে একদিন।
বিকেল হওয়ার অনেক আগে আমি আমাদের ডিটেকটিভ ক্লাবে পৌঁছে গেলাম। গিয়ে দেখি সবাই আগে পৌঁছে গেছে, এমন কি রবিনও। হীরা, নান্টু, মিশু, সলিল সবাই মিলে একটা মাঝারি সাইজের ফুটবল পাম্প করছে। বলটা রবিনের। রবিন কাটা হাতটা দিয়ে এমন চমৎকারভাবে পাম্পারটা ঠেসে ধরে পাম্প করে যাচ্ছিল যে মনে হচ্ছিল হাত কাটা থাকলেই বুঝি এসব কাজ করতে সুবিধা।
দারুণ একটা ফুটবল টিম খুলব। বলের লেসিং লাগাতে লাগাতে রবিন বলল, পৃথিবীর মাঝে সবচেয়ে ভাল।
আমরা রোমাঞ্চিত হলাম। সলিল বলল, ঠাকুরপাড়ার টিমটা খুব শক্ত। গতবার চার গোল খেয়েছি, তার আগেরবার ছয় গোল।
রবিন তাচ্ছিল্যের দৃষ্টিতে আমাদের দিকে তাকিয়ে বলল, তোরা দিনরাত মেয়েদের মত বুড়ী-চি খেলিস, ফুটবল খেলায় তো গোল খাবিই।
ইহ। বুড়ী-চি খেলি কে বলল তোকে? মারব থাবড়া– হীরা বাতাসের মাঝে ঘুষি মারল।
ঐ হল। ফুটবল কেটে কেটে ভাগ করে নিস, ফুটবল খেলিস না! তার মানেই বুড়ী-চি খেলিস!
আবার? আবার? হীরা দাঁত কিড়মিড় করে।
ফুটবলটি মাটিতে তিন চারবার ড্রপ দিয়ে রবিন বলল, চল খেলি গিয়ে।
আমরা হৈ হৈ করে বেরিয়ে এলাম। মাঠের ধারে গোল হয়ে বসে টিম ভাগ করতে লাগলাম। আমাদের মাঝে সলিল আর মিশু দারুণ খেলতে পারে। হীরাটার পায়ে জোর বেশি, ল্যাং মেরে টেনে হিঁচড়ে বল নিয়ে যায়, আসলে বেশি ভাল খেলতে পারে না। রবিন কি রকম খেলে কে জানে, তবে ওর যে রকম উৎসাহ, নিশ্চয়ই ভাল খেলে।
.
আমাদের সর্দার হবার মারামারিটা তার আগে হয়ে যাক। রবিন বলের উপর এক পা তুলে কাটা হাতটা নাচাতে নাচাতে বলল। অনেকক্ষণ ধরেই অস্বস্তির সঙ্গে আমার একথাটা মনে হচ্ছিল। হীরা গোঁ গোঁ করে বলল, ঠিক আছে। তারপর হাতা গুটিয়ে ফেলল। আমরা গোল করে জায়গা করে দিলাম।
রবিন শার্ট খুলে গেঞ্জি বের করে নিল। তারপর হীরার দিকে এগিয়ে এল। বলল আয়।
হীরা তার জায়গায় দাঁড়িয়ে বলল, তুই আয়।
আমি দেখেছি যেসব মারামারি হঠাৎ করে কোন কারণে শুরু হয়ে যায় সেগুলি চমৎকার চলতে থাকে। কিন্তু সামনাসামনি দাঁড়িয়ে খুব ধীরে ধীরে মারামারি শুরু করা দারুণ শক্ত। হীরা আর রবিন খুব কাছাকাছি দাঁড়িয়ে একজন আরেকজনের বুকে থাবা দিয়ে ফোঁসফোঁস করছিল। রবিন মাঝে মাঝে ঠেলে হীরাকে সরিয়ে দিচ্ছিল, হীরাও ঠেলে রবিনকে সরিয়ে দিচ্ছিল।
লেগে দেখ না! ছাতু বানিয়ে ফেলব। হীরা গরম হয়ে রবিনকে একটা মাপসই ধাক্কা দেয়।
ইহ! রবিন ঝটকা মেরে হীরার হাত সরিয়ে দেয়। বলে, কি করবি তুই? কাঁচকলা! তারপর কাটা হাতটা দিয়ে থুতনিতে টোকা মারে।
আরেকবার মার তো!
রবিন আরেকবার মারল, একই জায়গায় ঠিক একই ভাবে।
আরেকবার মেরে দ্যাখ তো। হীরার চোখ মুখ লাল হয়ে ওঠে। রবিন আবার ঠিক একই জায়গায় একই ভাবে মারল। সাথে সাথে হীরা রবিনের উপর ঝাঁপিয়ে পড়ল।
আমি বুঝতে পারলাম রবিনের গায়ে দারুণ জোর। হাতটা কাটা থাকার পরও সে হীরাকে এমন বেকায়দাভাবে ল্যাং মেরে ফেলে দিল যে আমি তাজ্জব হয়ে গেলাম। দুজন দুজনকে খামচে, ঝাপটে, ঘষটে ঘষটে ঘাসের উপর গড়াগড়ি দিতে লাগল। কখনও হীরা রবিনকে কাবু করে ফেলছিল কখনও রবিন হীরাকে। অনেকক্ষণ ধরে ওদের জাপটাজাপটি চলল, শেষ পর্যন্ত আমরাই বিরক্ত হয়ে ওদের ছাড়িয়ে দিলাম। দুজনকে ছাড়িয়ে দেবার পর ওরা দুজনেই দাবি করতে লাগল যে সে জিতেছে। হীরার সাথে নিষ্পত্তি না হওয়া পর্যন্ত আমার সাথে মারামারি শুরু হতে পারে না তাই ওটা আগামীকাল পর্যন্ত স্থগিত থাকল। এখন ফুটবল খেলব।
কিন্তু ফুটবল কোথায়? খুঁজে খুঁজে হয়রান হয়ে দেখি আমাদের ছোট ভাইয়ের দলটা ওটাকে দমাদম পিটিয়ে বাসার উঠনে খেলছে। রঞ্জুর কান মলে দিয়ে আমি বলটা নিয়ে এলাম। রঞ্জু, আমার ছোট ভাই, ভ্যাঁ করে কেঁদে দিল। আজ বাসায় এ নিয়ে ভোগান্তি হবে!
আমি বল নিয়ে এলাম, দল ভাগ করা হল, এক দিকে সলিল ক্যাপ্টেন আরেক দিকে রবিন। রবিন বলল ওকে ক্যাপ্টেন না বানালে সে খেলবে না, বল নিয়ে চলে যাবে। এমন বিচ্ছু ছেলে আমি আর দেখিনি।
ওকেই ক্যাপ্টেন করা হল। বলের মালিককে সব সময় একটু সুবিধা দিতে হয়। আর মালিক যদি রবিনের মত নচ্ছাড় বান্দা হয় তাহলে তো বটেই।