পাকা দাড়িওয়ালা লোকটা আমাদের একনজর দেখল তারপর কঠোর গলায় জিজ্ঞেস করল, তোমরা কারা? কোত্থেকে এসেছ?
রবিন উদ্ধত স্বরে জিজ্ঞেস করল, আপনি কে?
লোকটি ক্ষেপে গেল মনে হল। এগিয়ে এসে আরো কঠোর গলায় জিজ্ঞেস করল, কোত্থেকে এসেছ তোমরা? কি চাও?
আমরা মনে হচ্ছিল এ লোকটিই ইসমাইল খাঁ। একটু দ্বিধা করে জিজ্ঞেসই করে ফেললাম, আপনার নাম কি ইসমাইল খাঁ?
লোকটি ঘুরে আমার দিকে তাকাল। বলল, হ্যাঁ।
রবিন হঠাৎ একটা দীর্ঘশ্বাস ছাড়ল। তারপর ক্লান্ত স্বরে বলল, আপনাকেই আমাদের দরকার। আমাদের আপনার বাড়ি নিয়ে চলুন। তাড়াতাড়ি।
টিপু বলল, থানাতে এক্ষুনি একটা লোক পাঠাতে হবে। ঘণ্টাখানেকের মধ্যে যেন পৌঁছে যায়।
ইসমাইল খাঁ একটু হতভম্ব হয়ে তাকিয়ে রইলেন। বললেন, কি বলছ তোমরা? আমি কিছু বুঝতে পারছি না!
সব বুঝিয়ে দেব। রবিনের গলায় আবার কর্তৃত্বের স্বর ফুটে ওঠে, তাড়াতাড়ি নিয়ে চলুন, দেরি হলে সর্বনাশ হয়ে যাবে।
সবাই মিলে আমরা ইসমাইল খাঁর বাড়িতে ছুটলাম।
১৫. নারকীয় রাত
সে ভারি দুঃখের ব্যাপার, আমরা এতো কষ্ট করে ডাকাতদের হদিস জোগাড় করে আনলাম কিন্তু ডাকাতদের বাধা দেয়ার সব পরিকল্পনা করা হল আমাদের কোন কথা না শুনেই। এমনকি ইসমাইল খাঁ একবার আমাদের ঘরে গিয়ে শুয়ে পড়তে বললেন! রবিন অসহায় রাগে বসে বসে দাঁত কিড়মিড় করতে করতে আমাদের দিকে তাকাল।
সলিলকে ইসমাইল খাঁর ছোট ছেলের সাথে থানায় পাঠান হল। সলিল অবিশ্যি যেতে চাচ্ছিল না এখানকার মজাটাই সে দেখতে চায়, কিন্তু ওকে বোঝানো হল সে ফিরে এসেও মজা দেখতে পারবে।
ইসমাইল খাঁ চুপিচুপি কি আয়োজন করলেন আমরা জানতে পারলাম না। প্রচুর লোক জোগাড় করা হচ্ছে, গোপনে আরো দুটি বন্দুক আনা হয়েছে আর করিমন নামের মেয়ে লোকটিকে আটকে ফেলা হয়েছে এটুকুই শুধু টের পেলাম। কিন্তু ঠিক কিভাবে ডাকাতগুলিকে ধরা হবে, কিংবা ধরা হবে কিনা, কিছুই জানতে পারলাম না। আমাদের যখন কোন গুরুত্ব দেয়া হচ্ছিল না তখন ভীষণ খারাপ লাগছিল। রবিন একবার একটা বুদ্ধি বাতলে দিতে গেলে ইসমাইল খাঁ মুখ খিঁচিয়ে বলে উঠলেন, তোমরা ছেলে ছোকরারা এর মাঝে কেন?
রবিন চোখ মুখ লাল করে ফেরত আসল। অনেকক্ষণ গুম হয়ে বসে থেকে এক সময় আমার কানের কাছে মুখ এনে বলল, চল পালাই।
কোথায়?
বাইরে, এদের ভাব দেখে মনে হচ্ছে, ঠিক আসল সময়টাতেই আমাদের বের হতে দেবে না!
ঠিক বলেছিস! বলে আমরা খুব অন্যমনস্ক ভঙ্গি করে চুপিচুপি বাইরে বেরিয়ে এলাম। এতো উত্তেজনা এবং ব্যস্ততার মাঝে আমাদের কেউ খেয়াল করল না।
.
বাড়ি থেকে বেশ অনেকটা দূরে একটি বড় পেয়ারা গাছ পাওয়া গেল। আমরা চুপিচুপি সেটাতে উঠে বসলাম। আমি ভাঙা হাত নিয়ে কিছুতেই উঠতে পারছিলাম না, অন্যেরা টেনে তুললো। অনেক উপরে বেশ আরাম করে বসে রবিন বলল, এই জন্যে আমরা নিজের ফাইট দিতে চাচ্ছিলাম! দেখলি? আমাদের কেউ পাত্তা দিচ্ছে না?
ওদের দোষ কি। দেখেছে বয়েস কম।
বয়েস কম? বয়েসই কি সব? আমাদের কি ইয়ে কম আছে নাকি?
কিয়ে?
বুদ্ধি, সাহস, অস্ত্রশস্ত্র, কায়দা? আমরাই সব করলাম, অথচ অথচ –
আমরা চুপ করে থাকলাম। রবিন গজগজ করতে লাগল, ওর দুঃখ পাবার ন্যায্য কারণ আছে।
.
খানিকক্ষণ পরে দেখি ইসমাইল খাঁর লোকজন আমাদের খোঁজ করছে। নাম জানে না তাই খোকারা, খোকাসকল বলে ডাকছে। আমরা হাসি চেপে চুপচাপ গাছের ডালে বসে রইলাম। হীরা ফিসফিস করে বলল, খোঁজ ব্যটারা খোঁজ!
যখন খুঁজে পেল না তখন শুনলাম বলাবলি করছে, রাগ করেছে নাকি? কেউ নজর দিচ্ছিল না। না খেয়ে আছে নাকি কে জানে!
ধাপ্পা দিল না তো?
আজকালকার ছেলে ছোকরা।
হয়তো মজা করার জন্যে তবু সাবধান থাকা ভাল। বলা তো যায় না!
না মজা করেনি। ওদের একজন থানায় গেল না?
তা বটে। কিন্তু অন্যেরা গেল কই?
আমরা গাছে বসে খিকখিক করে হাসতে লাগলাম।
অনেকক্ষণ হল আমরা গাছে বসে আছি। আকাশে ভাঙা একটা চাঁদ, একটা নবম জ্যোৎস্না ছড়িয়ে আছে – ডুবতে দেরি নেই। বেশ ঠাণ্ডা বাতাস, অল্প অল্প হিম পড়ে মাথা ভিজে যাচ্ছে। কি একটা পাখি কাকক্যাক করতে করতে উড়ে গেল।
এক সময়ে ইসমাইল খাঁর বাড়ির সব আলো নিভে গেল। চুপচাপ সুমসাম করছে। বাইরে থেকে দেখে কে বুঝবে ভিতরে ভিতরে বাড়িটার চারিপাশে শক্ত পাহারা, লাঠি, সড়কি বন্দুক নিয়ে শ’খানেক লোক লুকিয়ে অপেক্ষা করছে।
.
বসে থাকতে থাকতে তন্দ্রামত এসে গেল, মনে হচ্ছে কয়েক যুগ বসে আছি। হঠাৎ রবিন খোঁচা মারল, আমি চমকে উঠলাম। আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিল দূরে ছায়ার মত কারা যেন চুপিচুপি গুড়ি মেরে আসছে। আমার দম বন্ধ হয়ে এল, বুকের ভিতর স্পষ্ট শুনতে পেলাম ঢিপঢিপ ঢিপঢিপ শব্দ। টিপু আমার কাঁধ খুব শক্ত করে খামচে ধরল। লোকগুলি ঠিক পেয়ারা গাছটার নিচে দিয়ে চুপিচুপি হেঁটে গেল ইসমাইল খাঁর বাড়ির দিকে। অন্ধকার তাই চেহারা ছবি দেখা যায় না, শুধু বন্দুকের নল আর লম্বা লম্বা লাঠি সড়কির মাথাগুলি আবছা দেখা যাচ্ছিল। লোকগুলি ভিতরে উঠনে ঢুকতেই রবিন নড়েচড়ে উঠল, ফিসফিস করে বলল, চল নামি।
মানে?
ভিতরে গিয়ে দেখি।
কি সর্বনাশ! এখন মারামারি হবে!
দেখবি না?
ভীতু বলে প্রমাণিত হতে হয় তাই চুপিচুপি সরসর করে গাছ থেকে নামতে লাগলাম। আমি তখনো নামিনি, প্লাস্টার করা হাতটা নিয়ে একটু বেকায়দায় পড়েছি। অমনি হঠাৎ দ্রুমদ্রাম গুলির শব্দ হল। স্যাঁৎ স্যাঁৎ করে চারদিকে মশাল জ্বলে উঠল হৈ চৈ শব্দে শ’খানেক লোক ডাকাত গুলোকে ঘিরে ফেলল।