কি বলল সেই বুঝল, আমি মাথা ঘামালাম না। বললাম, এই ছঘণ্টা আমরা কি করব?
একটা দল যাবে কাছাকাছি থানাতে পুলিশকে খবর দিতে। আরেকটা দল যাবে ডাকাতদের পিছু পিছু দরকার হলে ডাকাতদের আটকাবার জন্যে।
ইয়েস! রবিন বুকে টোকা মারল। সেটার লীডার আমি!
ইহ! হীরা মুখ বাঁকায়, দেখা যাবে।
কে কে থানাতে যাবে?
আমি না। আমি আগেই হাত তুলে না করলাম।
আমি তো লীডার, যাওয়ার প্রশ্নই ওঠে না। রবিন হাতড়ে হাতড়ে রিভলবারটা বের করে।
হীরা বলল, পুলিস দেখলে আমার ভয় করে।
সলিল বলল, আমার মোটেই ভয় করে না, কিন্তু তাই বলে মনে করিস না আমি যাব।
টিপু বলল, তাহলে? তাহলে কেউ থানাতে যাবে না?
দেখা গেল সত্যি কেউ থানাতে খবর পৌঁছে দিতে রাজি না। সবাই ডাকাতদের সাথে সাথে থাকতে চায়। শেষ পর্যন্ত ঠিক করা হল লটারি করা হবে। লটারি থেকে আমি আর রবিন বাদ পড়লাম, কারণ নৌকা নিয়ে থানায় যেতে হলে আমরা দুজন একেবারে অসহায়, দুজনেরই একটি করে হাত! আমি অবিশ্যি একবারও মনে করিয়ে দিলাম না হাঁটা পথেও থানাতে যাওয়ার পথ থাকা সম্ভব, তাহলে লটারির ঝুঁকিটুকু নিতে হয়!
.
টিপু কাগজ ছিঁড়ে তাদের তিনজনের নাম লিখল। ঠিক হল যে দুজনের নাম উঠবে তারা থানাতে যাবে, বাকি জন আমাদের সাথে থাকবে।
আমি লটারি করলাম। টিপুর ভাগ্যে আমাদের সাথে থাকার সৌভাগ্য হল, হীরা আর সলিলের ভাগ্যে উঠল থানায় যাওয়া।
হীরা মুখ গোঁজ করে বসে থাকল, কিন্তু তাতে লাভ কি? লটারি হচ্ছে লটারি।। তার সিদ্ধান্ত সবাইকে মানতে হয়।
১৪. ইসমাইল খাঁ
বিকেল সাড়ে চারটার দিকে আমরা পিছনে ডাকাতের নৌকাটা দেখতে পেলাম। ওরা অনেক পিছনে, টেলিস্কোপে অনেক কষ্ট করে আবছা মত দেখা যায় তবে খুব তাড়াতাড়ি ছুটে আসছে। সবগুলি ডাকাতই খুব দারুণ নৌকা বাইতে পারে। আর একেকটার স্বাস্থ্য কি!
একটু পরেই সন্ধে হয়ে আসবে, আমরা জোরে জোরে হাত চালালাম! শুভাপুর আর বেশি দূরে নয়, বামদিকে বিষখালি নদীর মুখ, ওদিক দিয়ে মাইলখানেক যেতে হবে। বিষখালির মুখে এসে দেখি ভাটার টানে পানি হুড় হুড় করে বের হচ্ছে। সে কী স্রোত! এই স্রোত ঠেলে যাওয়া আমাদের কর্ম নয়! আমরা সেখানেই নৌকা বেঁধে ফেললাম, বেশি দরকার হলে একমাইল হেঁটেই চলে যাব।
টিপু হাঁড়িতে পানি গরম করে চা, চিনি বের করতে লাগল। ওর নাকি বিকালে চা না খেলে বিকালটা কাটতেই চায় না! চা তৈরি করতে করতে ডাকাতের নৌকাটা এসে পড়ল, থামল আমাদের কাছ থেকে অল্প দূরে। সেখানেই লগি পুঁতে তার সাথে বেঁধে ফেলল। আমরা একে অন্যের দিকে তাকাতে লাগলাম, ভাগ্য ভাল থাকলে এরকমই হয়। রবিন আর আমি ছইয়ের ভিতর ঢুকে পড়লাম, আমাদের দেখলে চিনে ফেলতে পারে। একটু পরেই অন্ধকার হয়ে যাবে তখন আর কোন ভয় থাকবে না। ডাকাতেরা ভাত রাঁধার আয়োজন করতে লাগল, আমাদের আশে-পাশে থেমে থাকা নৌকাগুলিও দেখি ভাত চড়িয়ে দিতে লাগল। কিন্তু আমাদের আর ভাত রাঁধার উৎসাহ ছিল না। টিপু বুদ্ধি দিল চিড়ে আর কলা কিনে আনতে। হীরা টিপু আর আমি চাদর মুড়ি দিয়ে ভাল করে ঢেকেঢুকে চিড়ে কলা কিনতে গেলাম। লোকজনকে জিজ্ঞেস করে শুভাপুরের রাস্তা, ইদরিস খাঁর বাড়ি, কাছাকাছি থানায় যাবার সোজা পথ এসব জেনে আসব।
যাবার সময় রবিন আর সলিলকে আমরা নানাভাবে সাবধান করে এসেছি। ভীষণ শীত পড়েছে তার মাঝে গুটিশুটি মেরে আমরা চাদর জড়িয়ে যাচ্ছিলাম। আমার মনে হল গত পরশুদিনও জ্বরে বিছানায় শুয়ে ছিলাম! ভাগ্যিস আর জ্বর আসেনি।
বহুদূরে ছোট্ট একটা দোকান পাওয়া গেল। সন্ধ্যে হতে না হতেই ঝপ ফেলে বন্ধ করার আয়োজন করছে। আমরা চিড়ে কলা আর গুড় কিনলাম। আসার সময় ইদরিস খাঁর বাড়ি কোথায় জিজ্ঞেস করতেই দোকানদার একটু অবাক হয়ে তাকাল, জিজ্ঞেস করল, ক্যান?
একটু দরকার ছিল।
এখানে তো ইদরিস খাঁ বলে কেউ নেই।
কেউ নেই? আমরা হতবাক হয়ে একজন আরেকজনের দিকে তাকালাম। আবার জিজ্ঞেস করলাম, কেউ নেই?
ইসমাইল খাঁ আছে। খানবাড়ির।
সেই হবে, টিপু মাথা নাড়ে। আমাদের ভুল হয়ে গেছে।
ইসমাইল খাঁর বাড়িটাই কদ্দুর?
এখান থেকে আধক্রোশ, দক্ষিণে।
একটু ভাল করে চিনিয়ে দেন না, আমরা যাব।
দোকানদার আমাদের বুঝিয়ে দিল। কাঁচা সড়কটা ধরে এক মাইল গেলে একটা মসজিদ পাওয়া যাবে, শায়েস্তা খাঁর আমলের, সেটার বাম পাশে বাঁশের সাকো। ওটা পার হয়ে ছোট সড়কটা ধরে খালের পাশেপাশে গেলে বড় যে টিনের বাড়িটা চোখে পড়বে, সামনে বড় দিঘি, সেটাই ইসমাইল খাঁর বাড়ি। ধানের গোলা আছে আর সামনে বড় বড় পাচ ছয়টা খড়ের পালা।
আমি একটু ইতস্ততঃ করে জিজ্ঞেস করলাম, কাছাকাছি কোথায় থানা আছে বলতে পারেন?
দোকানদার একটু অবাক হয়ে এদিক সেদিক তাকাল তারপর বলল, থানা দিয়ে কি হবে?
কাজ ছিল, বলে টিপু খুব অন্তরঙ্গ সুরে আবার থানার কথা জিজ্ঞেস করল।
জানা গেল শুভাপুর গ্রামটা দুটি থানার ঠিক মাঝামাঝি জায়গায়। দুটি থানাই নৌকায় দু ঘণ্টা আড়াই ঘণ্টার পথ। তবে মিশু যেখানে আটকা আছে সেটি তুলনামূলক ভাবে কাছে। হেঁটেও যাওয়া যায়। ঠিক ঠিক শর্টকাট গলি ধরতে পারলে নাকি ঘণ্টা দেড়েকেও পৌঁছা যায়।
আমরা সব খবরাখবর নিয়ে আবার গুটিগুটি ফিরে এলাম। ফিরে আসার সময় দোকানদার কোথা থেকে এসেছি কোথায় যাব এইসব জিজ্ঞেস করছিল। আমরা না শোনার ভান করে পা চালিয়ে চলে এসেছি। আমার মনে হল ব্যাপারটা ভাল হল না, কিন্তু এছাড়া উপায়ও ছিল না।