পুলিসটা আমাদের খুব কাছে এসে দাঁড়াল। আমাদের খানিকক্ষণ ভাল করে লক্ষ্য করে জিজ্ঞেস করল, তোমাদের বাড়ি কোথায়?
ঢাকা। কেন জানি আমার মনে হল এখন বোকার মত উত্তর দেয়াই বুদ্ধিমানের কাজ।
এখানে কোথায় এসেছ?
চাচার বাড়ি।
চাচার বাড়ি কোথায়?
হীরা ফ্যাকাসে মুখে আমার দিকে তাকাল। আমি একবার ঢোক গিললাম। ইশ! এই এলাকার একটা গ্রামের নামও জানি না! থানাটার নামটা পর্যন্ত ভাল করে পড়ে আসলাম না।
কোথায় চাচার বাড়ি? পুলিসটা আরেকটু এগিয়ে এল। মনে হল খপ করে হাত ধরে ফেলবে! আমি সন্তর্পণে একটু পিছিয়ে এসে বললাম, পলাশপুর, নাজিরপুর থানায়।
সত্যি সত্যি নাজিরপুর থানায় পলাশপুর নামে একটা গ্রাম আছে, স্কুল থেকে একবার পিকনিকে গিয়েছিলাম। তবে সেটি বহুদূরে।
পুলিসটা একটু থতমত খেয়ে বলল, তা এখানে কি করছ?
চাচার সাথে এসেছি।
চাচা কই?
মাছ কিনতে গেছেন। এক্ষুনি এসে পড়বেন। ঐ তো আমাদের নৌকা আমি একটা নৌকা দেখিয়ে দিলাম।
কতক্ষণ যে এভাবে একনাগাড়ে মিছে কথা বলতে হবে কে জানে। আর এই ব্যাটা পুলিস আমাদের পিছু লাগল কেন বুঝতে পারলাম না। সে এবারে হীরাকে ধরল। তোমার বাড়ি কোথায়?
হীরা কিছু বলার আগেই আমি বলে উঠলাম, ও আমার চাচাত ভাই। ওর আব্বার সাথেই আমরা টাউনে যাচ্ছি।
পুলিসটা একটু হতাশ হল মনে হল। তবু আমাকে জিজ্ঞেস করল, নাম কি তোমার?
খালেকুজ্জামান চৌধুরী। আমি রঞ্জুর নামটা বলে দিলাম!
তোমার?
শফিক আহমেদ।
শফিক ভাইয়ের নামটা হীরা নিজের নাম বলে চালিয়ে দিল। পুলিসটা একটু কুটিল চোখে তাকাতেই হীরা বিবর্ণ হয়ে বলল, পুরো নাম শফিক আহমেদ চৌধুরী।
আব্বার নাম?
নাজির আহমেদ চৌধুরী। এবারে হীরা আর চৌধুরী বলতে ভুল করল না।
পুলিসটা আমাদের লক্ষ্য করতে করতে বলল, এদিকে তোমাদের বয়েসী কোন ছেলেপেলে দেখেছ? একজনের হাত কাটা, আরেকজনের হাত ভাঙা? মোট ছয়জন?
হীরার চোয়াল ঝুলে পড়ল আর আমার হৃদপিণ্ড লাফিয়ে গলার কাছে উঠে ধুক ধুক করতে লাগল। পুলিসটা তাহলে আমাদেরই খোঁজ করছে! জ্বর ছিল বলে চাদর গায়ে বেরিয়েছি প্লাস্টার করা হাতটা ঢাকা, নইলে কথাবার্তা না বলে ক্যাঁক করে ঘাড় আঁকড়ে ধরত। পুলিস তাহলে আমাদের সবাইকে খোঁজ করছে। কিন্তু এত তাড়াতাড়ি খোঁজ পেল কেমন করে? আমি আন্দাজ করলাম, মিশুর আব্বা ডি. এস. পি., তিনিই হয়তো আশেপাশে সব থানাতে ফোন করে দিয়েছেন। আমি আড়চোখে হীরার দিকে তাকালাম হীরা আমার দিকে তাকাল। আমি একটু ঘুরে নদীতে গোসল করতে থাকা রবিনকে দেখতে গিয়ে থেমে গেলাম। পুলিসটাও যদি ওদিকে তাকায়? তাহলে বুঝতে কিছু বাকি থাকবে না! এখন যদি রবিন গোসল শেষ করে কাটা হাতটা দুলিয়ে দুলিয়ে ফিরে আসে? কিংবা বাতাসে চাদরটা উঠে গিয়ে যদি প্লাস্টার করা আমার হাতটা বেরিয়ে পড়ে? আমি চাদরটা ভাল করে জড়িয়ে হাত দুটো চাঁদরের তলাতেই ভাঁজ করে বুকের উপর রাখলাম। দেখতে এখন একটু চালিয়াৎ মনে হলেও কেউ সন্দেহ করবে না একটা হাত প্লাস্টার করা! তবুও আমার বুক ঢিপঢিপ করতে লাগল।
দেখেছো, না? পুলিসটা আমাদের এরকম হতভম্ব হতে দেখে উৎফুল্ল স্বরে জিজ্ঞেস করল। আমি ঢোক গিলে মাথা নাড়লাম।
কোথায় দেখেছ? কোন্ দিকে গেছে!
এই তো এদিকে। আমি থানার পাশে ডিস্ট্রিক বোর্ডের বড় সড়কটা দেখিয়ে দিলাম।
কখন গেছে? পুলিসটা একটু উত্তেজিত হয়ে জিজ্ঞেস করল।
এই তো এই মাত্র। পাঁচ মিনিটও হয়নি।
হীরা ঢোক গিলে বলল, একজনের বাম হাতটা কাটা।
আমি বললাম, না ডান হাতটা। যদিও খুব ভাল করে জানি রবিনের বাম হাতটাই কাটা।
ইশ! হীরা সত্যি সত্যি ক্ষেপে উঠে বলল, বাম হাত না? সেই যে
ধেৎ! এই দিক দিয়ে গেল, ডান হাতটা কাটা। আরেকজনের হাতে প্লাস্টার ওরও ডান হাত। আমি ডান হাতটা বের করে হীরার নাকের উপর দিয়ে ঘুরিয়ে আনলাম।
পুলিসটা আমাদের ঝগড়া থামিয়ে দিয়ে দ্রুতপায়ে থানার দিকে হেঁটে গেল। আমি খুব সন্তর্পণে একটা স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে নদীর দিকে তাকালাম। রবিন শার্ট পরে এগিয়ে আসছে।
কাছে এসে রবিন উত্তেজিত মুখে কি একটা বলতে যাচ্ছিল হীরা মুখ খিঁচিয়ে উঠল আর আমি দাবড়ানি মেরে তাকে থামিয়ে দিলাম। আমার মুখে সব শুনে রবিনের চোখ কপালে উঠল, বলল, সর্বনাশ! তাড়াতাড়ি নৌকায় চল।
নৌকায় যেতে যেতে রবিন বলল, ডাকাতেরা আজ রাতে শুভাপুরে ডাকাতি করবে।
সত্যি?
হা, ইদরিস খাঁর বাড়িতে।
স্পষ্ট শুনেছিস, নিজের কানে?
না, অন্যের কানে বলে রবিন মুখ খিঁচিয়ে উঠল। কথা না বলে আমরা ছুটতে ছুটতে নৌকায় এসে উঠলাম।
নৌকায় পৌঁছে দেখি রান্নাবান্না শেষ। মিশু বাজারে গেছে আমাদের খুঁজে আনতে। সলিল আর টিপু আমাদের খুব একচোট গালি দিতে যাচ্ছিল, কিন্তু আমাদের মুখে সব শুনে ফ্যাকাসে মেরে গেল। সলিল শুধু বলল, সর্বনাশ! মিশুকে যে এ এলাকার সব পুলিস চেনে, ওদের বাসাতে প্রায়ই যায়!
মিশুর জন্যে চিন্তায় পড়ে গেলাম। টিপু খুব সাবধানে নদীর তীর দিয়ে মিশুকে খুঁজতে গেল। একটু পরে ছুটতে ছুটতে হাজির হল। লাফিয়ে নৌকায় উঠে বলল, নৌকা ছাড়ো! মিশুকে পুলিস ধরেছে।
ভাটা শুরু হয়ে গিয়েছিল। দ্রুত বৈঠা ফেলে নৌকা নিয়ে আমরা সামনে অদৃশ্য হয়ে যেতে যেতে তীরের দিকে তাকালাম। একজায়গায় খুব ভিড়। নিশ্চয়ই মিশুকে যেখানে ধরা হয়েছে সেখানেই ভিড়টা। আহা বেচারা! ওকে দেখামাত্র নিশ্চয়ই চিনে ফেলেছিল, মিথ্যে কথা বলার সুযোগও পায়নি। ওর চিন্তা নেই অবিশ্যি আরামে বাসায় পৌঁছে যাবে, বাসায় একটু আধটু পিটুনি খেতে পারে, (সে তো আমরাও খাব) কিন্তু ডাকাত ধরার আনন্দ তো আর পেল না।