টিপু অনেকক্ষণ ভেবে বলল, আমরা যদি আগে জানতে পারি ওরা কবে কোথায় ডাকাতি করবে তাহলে টোপনের বুদ্ধিটা কাজে লাগানো যেতে পারে।
সবাই একটু চিন্তা করে সায় দিল, কিন্তু সমস্যা হচ্ছে ওদের পরিকল্পনা আগে থেকে জানা যায় কেমন করে?
ওরা তো মাইক ভাড়া করে চেঁচিয়ে বেড়াবে না যে আমরা অমুক দিন অমুক জায়গায় এতটার সময় ডাকাতি করব! রবিন বিরক্ত হয়ে বলল, এর থেকে সোজাসুজি একটা ফাইট দেয়া কতো ভাল!
১২. পুলিস কেলেঙ্কারি
বেলা চড়ে এলে নৌকায় রান্নার আয়োজন শুরু হয়ে গেল। বাসনপত্র কম আনা হয়েছে। তবু যাহোক কাজ চালান যেত কিন্তু ভাতটাই কিছুতেই সেদ্ধ করা যাচ্ছে না। টিপু বাসা থেকে কেরোসিনের চুলা নিয়ে এসেছিল সেটি মাঝে মাঝে হঠাৎ দপ করে বিরাট বড় শিখা নিয়ে জ্বলে ওঠে। হাত পুড়ে, গুঁড়ো মশলা চোখে ঢুকে বিচ্ছিরি অবস্থা। শেষ পর্যন্ত বিরক্ত হয়ে টিপু, সলিল আর মিশুকে বসিয়ে রেখে আমি হীরা আর রবিন বেড়াতে বের হলাম। উদ্দেশ্য ডাকাতদের নৌকাটা কাছে থেকে লক্ষ্য করব, সেই ফাঁকে বাজারটাও ঘুরে আসব।
গায়ের চাদরটা খুব ভাল করে গায়ে জড়িয়ে আমি উল্টো দিক থেকে ঘুরে এসে খুব অন্যমনস্কর ভাব করতে করতে ডাকাতদের নৌকাটার দিকে এগিয়ে গেলাম। ভিতরে প্রায় খালি গায়ে বসে থাকা কালো কুচকুচে লোকগুলি আমার দিকে কড়া চোখে তাকাল। আমি উদাস ভাবে চোখ ঘুরিয়ে নৌকাটার খুব পাশে দিয়ে হেঁটে গিয়ে নদীতে হাঁটু পানিতে নেমে হাত মুখ ধুতে লাগলাম। ঠাণ্ডা পানিতে সারা শরীর শিরশির করে উঠল কিন্তু উপায় কি? আমি কান তীক্ষ্ণ করে ওদের কথাবার্তা শোনার চেষ্টা করলাম। কিন্তু চাপা গলায় ঝগড়ার সুরটাই ধরা পড়ল, কোন কথা বোঝা গেল না।
একটু পরে আমি উঠে এলাম। আড়চোখে ওদের লক্ষ্য করে শার্টের হাতা দিয়ে মুখ মুছতে মুছতে রবিন আর হীরার কাছে ফিরে এলাম। ওরা অল্প দূরে আমার জন্যে অপেক্ষা করছে। রবিন জিজ্ঞেস করল, কিছু বুঝতে পারলি?
কিচ্ছু না!
কথাবার্তা শোনা যাচ্ছিল?
না, শুধু ঝগড়া করছে। আমার দিকে এমন কড়া চোখে তাকাল—
সত্যি?
সত্যি! আর আমাকে দেখেই ওরা ফিসফিস করে কথা বলতে শুরু করল। কিচ্ছু শোনা যায় না।
এবারে তাহলে আমি ওদের কাছ থেকে ঘুরে আসি। হীরা শার্টের হাত গুটিয়ে প্রস্তুত হতে থাকে।
না, এক্ষুনি না। রবিন গম্ভীর ভাবে বলে, তাহলে সন্দেহ করবে। চল বাজার থেকে ঘুরে আসি।
আমরা বাজারটা ঘুরতে গেলাম। বুধবার করে সেখানে হাট হয় তখন নাকি বাজার খুব জমে ওঠে। আজ মাত্র সোমবার। আমরা সেই ছোট বাজারটাই ঘুরে ঘুরে দেখতে লাগলাম। মাছের বাজারে মাছের আঁশটে গন্ধে থাকা যায় না। ছোট ছোট কুচো মাছের ভাগ ছ পয়সা করে দাম; একটা মাঝারি রুই মাছ হীরা দাম করল, চার টাকা, সাড়ে তিন টাকাতে দিয়ে দিতে পারে। কিছু কই মাছও আছে দেড় টাকা কুড়ি। এক পাশে আলু পটল টমেটো এই সব তরিতরকারি। দুই পয়সা দিয়ে রবিন দুটো আতা কিনল, ভারি মিষ্টি খেতে। একটা বড় বট গাছের নিচে লাল টিনের ঘরে পোস্ট অফিস, আমি একটা পোস্ট কার্ড কিনলাম নান্টুকে চিঠি লিখব বলে। রবিন অবিশ্যি চেঁচামেচি করতে লাগল এখন চিঠি লিখলে পোস্ট অফিসের ছাপ দেখে আমাদের খুঁজে বের করে। ফেলবে।
বাজারের শেষ মাথা থেকে বড় মাটির সড়ক চলে গেছে। একটু দূরে একটা পাকা দালান। বাইরে সেন্ট্রি। পাহারা দিচ্ছে দেখে বুঝতে পারলাম ওটি হচ্ছে থানা। কাছে গিয়ে দেখলাম নীল রংয়ের উপর সাদা রং দিয়ে থানার নাম লেখা। রবিন অর্থপূর্ণ দৃষ্টিতে আমার আর হীরার দিকে তাকাল। আমরা থানাটাতে কতজন পুলিস আছে অনুমান করার চেষ্টা করলাম, পরে প্রয়োজন হতে পারে।
হঠাৎ করে রবিনের খেয়াল হল আমরা অনেকক্ষণ হল ডাকাতের নৌকাটা ছেড়ে এসেছি, ওটাকে একনজর দেখে আসা দরকার। ছেড়েই দিল কিনা কে জানে!
তাড়াতাড়ি আমরা বাজারটার মাঝে দিয়ে হেঁটে নদীর তীরে রওনা দিলাম। মাছ বাজারের পাশে দিয়ে যাওয়ার সময় লক্ষ্য করলাম একটা খাকী পোশাক পরা ঢিলেঢালা পুলিস মাছ দাম করছে। লোকটাকে কেমন একটু চেনা চেনা মনে হল। হয়তো মিশুদের বাসায় দেখে থাকব। পা চালিয়ে নদীর তীরে এসে দেখি দূরে ডাকাতদের নৌকাটা এখনো দেখা যাচ্ছে, আরো দূরে আমাদের নৌকাটা। ডাকাতদের নৌকাটা ঢেউয়ের সাথে সাথে অল্প অল্প দোল খাচ্ছিল। একজন ডাকাত মাটির গামলায় করে কি যেন ধুয়ে ভিতরে ঢুকে গেল।
হীরা বলল, এবারে আমি যাই।
রবিন বলল, দাঁড়া আগে আমি ঘুরে আসি। তারপর শার্টটা খুলে কাঁধে ফেলে গম্ভীর ভাবে হেঁটে গেল! নৌকাটার কাছে গিয়ে গেঞ্জিটাও খুলে ফেলল, তারপর সেগুলি একটা ঝোপের উপর রেখে আস্তে আস্তে নৌকার পাশ দিয়ে নদীর পানিতে নামতে লাগল। ওর ভাব দেখে মনে হচ্ছিল গোসল করবে। নৌকাটার খুব কাছে ঘেঁষে দুটো ডুব দিয়ে উঠে ও খুব কায়দা করে গা হাত পা ডলতে লাগল। দেখে বোঝা যাচ্ছিল না কিন্তু আসলে নিশ্চয়ই ও কান খাড়া করে রেখেছে। হঠাৎ গা রগড়ানো বন্ধ করে কান খাড়া করে নৌকার দিকে ঝুঁকে পড়ল, নিশ্চয়ই খুব গুরুত্বপূর্ণ কিছু শুনতে পেয়েছে। ঠিক সেই সময়ে একজন ডাকাতকে বের হতে দেখে ও বিপুল লেগে বুক ঘাড় রগড়ে রগড়ে ময়লা বের করতে লাগল, ঈশ্বরের কৃপায় সেটির ওর অভাব ছিল না। ডাকাতটি আবার ভিতরে ঢুকে গেল। আমার বুক ধুকধুক করছিল, আমি এদিক সেদিক তাকালাম। এমন সময় দেখি মাছ বাজারে দেখা সেই ঢিলেঢালা পুলিসটা হাতে এক কুড়ি কই মাছ নিয়ে আমাদের দিকে এগিয়ে আসছে। আমি হীরাকে একটু টিপে দিয়ে গম্ভীর ভাবে একটা ঘাস ছিঁড়ে নিয়ে চিবুতে লাগলাম!