মিশু আমার জুতো খুলতে সাহায্য করতে করতে বলল, তোর সাহস আছে সত্যি!
সলিল দাঁড়টা ছপাৎ করে ফেলে এক টান দিয়ে বলল, টোপনের সত্যি খুব সাহস। একলা একলা কেমন শ্মশানের ভেতর দিয়ে চলে এল!
আমি খুশিতে হাসতে হাসতে বললাম, ডাকাতদের নৌকাটা কতদূর?
ও! অনেক সামনে। এই দ্যাখ, বলে রবিন টেলিস্কোপটা আমার হাতে দিল। ঐ ছোট্ট আলোটাতে ফোকাস কর।
.
ফোকাস করে আমি টিমটিমে একটা হারিকেন দেখতে পেলাম, ওটাই নাকি নৌকাটা! আর কিছু দেখা যাচ্ছে না। হঠাৎ করে মনে হল কাসেমকে দেখছি না। বললাম, কিরে কাসেম কই?
বুঝলাম না। ও আসল না কেন? বোধ হয় আসার ইচ্ছে নেই।
আমারও তাই মনে হচ্ছিল।
আমি বললাম, আমি না আসলে তো তোদের মানুষই কম পড়ত। কাসেমও নেই নান্টুও নেই।
তুমি এসেই আমাদের লাভ কি! টিপু হাসতে হাসতে বলল, হাতখানা ভাঙা, তার ওপর জ্বর! তুমি বরং ভিতরে গিয়ে কম্বল গায়ে দিয়ে শুয়ে থাক। দেখে কেমন চমৎকার চাটাইয়ের ছই তৈরি করেছি, ভিতরে ঠাণ্ডা বাতাস আসতে পারবে না।
রবিন গম্ভীর হয়ে বলল, হ্যাঁ টোপন, ভিতরে গিয়ে শুয়ে থাক। একটা ট্যাবলেট খেয়ে নিবি নাকি? অনেক ওষুধ এনেছি।।
ওর ভাবখানা ওর আব্বা ডাক্তার তাই সেও হাফ ডাক্তার! আমি বললাম, না, আমি নিজের ওষুধগুলিই এনেছি।
.
আমি পকেট থেকে মিকচারের শিশি, ট্যাবলেটের প্যাকেট বের করতে লাগলাম। হীরা বাইরে থেকে চেঁচাল, আধাঘণ্টা হল কিনা দ্যাখ। আমার হাত ব্যথা হয়ে গেছে। টিপুর হাতে একটা জ্বলজ্বলে ঘড়ি। দেখে বলল, আর মাত্র চার মিনিট।
হীরা জোরে জোরে বৈঠা চালাতে লাগল। আমি ভিতরে গিয়ে শুয়ে পড়লাম। একটু দুর্বল, একটু অসুস্থ লাগছিল কিন্তু খারাপ লাগছিল না মোটেই। রিভলবারটির কথা মনে হল, উঠে বসে অকারণেই গলা নামিয়ে জিজ্ঞেস করলাম, রিভলবারটি এনেছিস তো?
হ্যাঁ হ্যাঁ! ওসব ভুল করি নাকি? রবিন দাঁত বের করে হাসল। বলল, তুই নিশ্চিন্ত মনে ঘুমো।
হ্যাঁ তুমি বিশ্রাম নাও। টিপুর গলা শুনতে পেলাম। অন্ধকারে মুখের ভাব দেখা যায়। না আন্তরিক সুরটা শুধু ধরা পড়ে।
শুয়ে শুয়ে পুরো ব্যাপারটা ভাবতে চেষ্টা করলাম। হঠাৎ মনে হল, যদি নৌকা ডুবে যায়? তাহলে এক হাতে সাঁতরাতে না পেরে টুপ করে ডুবে যাব। তার উপর স্রোতের কি টান! আমি জোর করে চিন্তাটা সরিয়ে দিলাম। শুধু খারাপ খারাপ জিনিস চিন্তা করলে কি আর কোন কাজ করা যায়!
আমি ঘুমানোর চেষ্টা করলাম। শুনতে পেলাম সলিল গুনগুন করে গান গাচ্ছে। ওর গানের গলাটা চমৎকার।
১১. প্রথম সকাল
আমার ঘুমটা গাঢ় হল না, অসুস্থ হলে হয়ও না। আমি আধে! ঘুম আধো জাগরণে আবছা আবছা ভাবে ওদের কথাবার্তা শুনছিলাম। ওরা মাঝে মাঝে জায়গা বদল করছে টের পাচ্ছিলাম, একবার হীরাকে খানিকক্ষণ গালিগালাজ করতেও শুনলাম। কিছু সময় কে যেন আমার পাশে শুয়ে থাকল। শেষ রাতের দিকে মনে হল নৌকাটা থামানো হয়েছে।
আমি কিছু জিজ্ঞেস করব করব ভেবে আবার ঘুমিয়ে বিচিত্র সব স্বপ্ন দেখতে। লাগলাম। বিরাট বড় গোলক ধাঁধায় আটকে পড়ে ঘড়ির কাটার সাথে সাথে ঘুরছি আর প্রতিবারই হিসেব ভুল করে একই দিকে সরে আসছি। লাল নীল হলুদ রংয়ের চক্র ছোট থেকে বড় হয় ক্রমাগত মিলিয়ে যাচ্ছিল আবার নতুন করে তৈরি হচ্ছিল। দেখতে দেখতে একসময় আমার ঘুম ভেঙে গেল, ভীষণ তৃষ্ণা পেয়েছে। আমি উঠে বসে আবছা অন্ধকারে দেখতে পেলাম ঐটুকু জায়গায় জড়াজড়ি করে সবাই শুন্তে আছে। বাইরে রবিন শুধু কম্বল গায়ে জড়িয়ে প্রেতের মত বসে আছে। আমি ডাকলাম রবিন –
উঁ
নৌকা থামিয়ে রেখেছিস?
হ্যাঁ। ডাকাতেরাও থেমেছে।
কতদূর আছে?
বেশিদূর না।
কি করছে?
কিছু না। জোয়ারের সময়টুকু বোধ হয় ওরা এখানেই থাকবে। তোর জ্বর আছে এখনো?
নাহ! পানি আছে খাবার?
চারিদিকে এতো পানি? খা না কত খাবি।
ধেৎ! নোংরা!
ঐ খেতে হবে। আমরাও এই খাচ্ছি। বলে সে একটা মগ বের করে নদী থেকে পানি তুলে আমার দিকে এগিয়ে দিল। আমি একটু ইতস্তত করে ঢকঢক করে খেয়ে ফেললাম। বুকটা যেন জুড়িয়ে গেল।
কয়টা বেজেছে?
হাতে বাঁধা টিপুর ঘড়িটা দেখে রবিন বলল, পৌনে পাঁচ।
সকাল হয়ে গেছে তাহলে।
হ্যাঁ—কি সুন্দর লাগছে, উঠে এসে দ্যাখ। রবিন হাত দিয়ে বাইরে দেখায়।
আমি হামাগুড়ি দিয়ে বাইরে এসে বসলাম। কুয়াশা পড়ে নৌকার পাটাতন ভিজে আছে। জোয়ারের পানি ছলাৎ ছলাৎ করে নৌকার উপর আছড়ে পড়ছে। চারিদিকে ধোঁয়াটে একটা ভাব। আলো যেন গুঁড়ো করে কেউ পাউডারের মত ছড়িয়ে দিচ্ছে। আমি একটু বিলের মত তাকিয়ে রইলাম। একবারও মনে হল না জ্বর নিয়ে বাসা থেকে পালিয়ে ডাকাতের পিছু পিছু নোকায় বসে আছি। নদীর বাঁক, দুধারে গাছ গাছালি, আবছা মাটির ঘর, আকাশে হালকা মেঘ, পুব দিকে লালচে আভা, শুকতারা। জ্বলজ্বল করছে, সব মিলিয়ে ভারি আশ্চর্য।
রবিন উঠে দাঁড়াল, বলল, এখন টিপুর পাহারা, পাঁচটা বেজে গিয়েছে। তারপর হামাগুড়ি দিয়ে ছইয়ের ভিতর ঢুকে টিপুকে খোঁচাতে লাগল, এই টিপু ওঠ! এই টিপু
টিপু বার দুয়েক উ আঁ করল কিন্তু উঠল না। দেখে আমার মায়া হল, আমি রবিনকে বললাম, শুধু শুধু ওকে ডাকিস না, আমি পাহারা দিছি। বেচারা ঘুমাক।
তুই? তোর না জ্বর?
ভাল হয়ে গেছে।
দেখিস আবার বলে রবিন শুয়ে পড়ল এবং শুতে না শুতেই ঘুম। নিশ্চয়ই খুব ক্লান্ত হয়ে আছে।