বাইরে একেবারে ঘুটঘুটে অন্ধকার! রাত কয়টাই বা হয়েছে অথচ কোথাও একটি লোক নেই। আমি রাস্তার ধার ঘেঁষে যত তাড়াতাড়ি সম্ভব হাঁটতে লাগলাম। মোড়টা পার হলেই সার্কিট হাউজের পাশের সেই বটগাছটা – যেখানে নাকি রাত গভীর হলেই জ্বিনেরা নাচগান করে! জায়গাটা একা কেমন করে পার হব ভেবে আমার এই শীতেই কপাল ঘেমে উঠতে লাগল।
আচ্ছন্নের মত আমি দ্রুত পায় হাঁটতে লাগলাম, মাঝে মাঝে নিজের পায়ের শব্দ শুনে আমি নিজেই চমকে উঠছি। যত দোয়া দরুদ জানা ছিল আমি একটির পর একটি আওড়ে যাচ্ছিলাম, নদীর ঘাটে পৌঁছার বেশি বাকি নেই। হঠাৎ রাস্তা খুঁড়ে কোথেকে একটি লোক হাজির হল, দেখে আমার হৃদপিণ্ড লাফিয়ে গলার কাছে এসে ধ্বক ধ্বক করতে লাগল। লোকটি বিরাট, ছোটখাট পাহাড়ের মত দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে একটা সিগারেট ধরানোর চেষ্টা করতে লাগল। আমি খুব সন্তর্পণে রাস্তা পার হয়ে হন হন করে হাঁটতে লাগলাম। লোকটি ম্যাচের কাঠির আলোতে আমাকে দেখার চেষ্টা করল বলে মনে হল। যখন দৌড় দেব কিনা ভাবছিলাম তখন সে কাঠিটা ফেলে আপন মনে বিড়বিড় করে জড়িত স্বরে বলল, লে বাবা! শিয়াল টিয়াল নাকি? তারপর উল্টো দিকে হাঁটতে শুরু করল, দেখলাম অল্প অল্প টলছে।
.
এত বিপদের মাঝেও আমার হাসি পেল। লোকটা আমাকে কিনা শেষ পর্যন্ত শেয়াল ভাবল? নিশ্চয়ই মদ খেয়েছে। এদিকে কাছেই কোথায় মদের দোকান আর খারাপ জায়গা টায়গা আছে।
.
কিভাবে কিভাবে শেষ পর্যন্ত আমি নদীর তীরে এসে পৌঁছে গেলাম। পথে দুজন টহল পুলিসকে দেখে শুধু খানিকক্ষণ গাছের আড়ালে লুকিয়ে ছিলাম, ওরা দেখলে মুশকিল হত। বাজারটার মুখে একটা কুকুরও খুব বিরক্ত করেছিল, ঘেউ ঘেউ করে মনে হচ্ছিল বাজারের সব লোক তুলে ফেলবে। আমি অবিশ্যি খুব তাড়াতাড়ি হেঁটে চলে এসেছি। কিন্তু নদীর তীরে এসে আমি বিভ্রান্ত হয়ে পড়লাম। খুব উদ্বেগ নিয়ে যেখানে টিপুর নৌকা বাঁধা থাকে সেখানে ছুটে গিয়ে দেখি ওখানে কিছু নেই। কাছে গিয়ে দেখলাম টিপুর নৌকার শিকলটা পানিতে ডুবে আছে। আর কিচ্ছু নেই—কোন চিহ্ন নেই, ওরা চলে গেছে!
কতক্ষণ আগে গেছে? কোনদিকে গেছে? ভাবতে গিয়ে অসহায় বোধ করলাম। হঠাৎ করে আমি ভীষণ দূর্বল বোধ করতে লাগলাম। মনে হল সেখানেই মুখ ঢেকে বসে পড়ি। এতক্ষণ যে জোরটা আমাকে ছুটিয়ে এনেছে সেটা যেন কর্পূরের মত উবে গেছে। ঠিক তক্ষুণি আমার মনে হল প্রতিমুহূর্তে ওরা আরো দূরে চলে যাচ্ছে। এক্ষুনি রওনা দিতে হয়। কিন্তু কোনদিকে?
নদীতে তখন মাত্র ভাঁটা শুরু হয়েছে, কয়েকটা কচুরিপানা ভাসতে ভাসতে দক্ষিণ দিকে যাচ্ছে। আমার মনে হল ডাকাতেরা নিশ্চয়ই ভাঁটার জন্যে অপেক্ষা করছিল। ভাঁটা শুরু হওয়ার পর এখন নিশ্চয়ই স্রোত ঠেলে উল্টো দিকে যাবে না। আমি ভাল হাতটা দিয়ে টেনে ব্যাগটা কাঁধে তুলে নিলাম তারপর দক্ষিণ দিকে ছুটলাম। বিদ্যুৎ ঝিলিকের মত মনে হল একটু দূরেই সেই শ্মশানটা!
অন্ধকার রাত। হাজার হাজার তারা আর একটা বিবর্ণ চাঁদের আলোতে আমি ছুটে চলেছি। মাঝে মাঝে দেখছিলাম নদীতে কোন নৌকা দেখা যায় কিনা। কাটা গাছ, লতাপাতা কাদা, গোবর কোন কিছুকে ভ্রুক্ষেপ না করে আমি হাঁপাতে হাঁপাতে ছুটতে লাগলাম, প্লাস্টার করা বাম হাতটা ভারি অসুবিধা করছিল। কম্বলটা মনে হচ্ছিল অতিকায়, ব্যাগটা মনে হচ্ছিল সীসে দিয়ে ভরা। আমার দৌড়ের সাথে সাথে ওগুলি ঝক্করঝক্কর করে কাঁধে লাফাতে লাগল, মাঝে মাঝে চোয়ালের সাথেও ঘষে যাচ্ছিল।
.
শ্মশানের পাশ দিয়ে যখন ছুটে যাই হঠাৎ আমার তখন মনে হল পিছনে পিছনে কেউ আমার সাথে ছুটে আসছে, এই বুঝি ধরে ফেলল – এই বুঝি ধরে ফেলল! আমি পিছনে ফিরে তাকাতে সাহস পাচ্ছিলাম না, যদি দেখি সত্যিই কেউ আসছে! ভয়ে আতঙ্কে আমি মৃত প্রায় হয়ে গেছি হঠাৎ দেখি নদীতে কালোমত একটা নৌকা দেখা যাচ্ছে। কার নৌকা, কিংবা আসলে নৌকাই কিনা আমি জানি না – তবু আশায় ভর করে, ছুটতে ছুটতে প্রাণপণে চেচাঁলাম, র… বি…ন…
.
ছুটতে ছুটতে ওটার কাছাকাছি এসে দেখি নৌকাই বটে, তবে টিপুর নৌকা না। সেটাতে ছই ছিল না। হতাশায় আমি ভেঙে পড়লাম, ক্লান্তিতে শেষ হয়ে যাচ্ছিলাম, তবুও আমি থামলাম না। সামনে নিশ্চয়ই ওরা আছে।
ঠিক সেই মুহূর্তে বিদ্যুৎ ঝলকের মত রবিনের গলার স্বর শুনলাম, টো…প…ন…কোথায়?
.
আনন্দে আমার চোখে পানি এসে গেল। ওটা টিপুর নৌকাই, ছই লাগিয়ে নিয়েছে। আমি ভাল হাতটা নাড়তে নাড়তে ছুটে গেলাম। নৌকাটা তীরের দিকে ছুটে আসতে লাগল। পানিতে বেশ কিছু দূর থাকতেই আমি জুতো টুতো নিয়ে লাফিয়ে পড়লাম। ওরা আমাকে টেনে নৌকায় তুলে ফেলল।
আমি হাঁপাতে হাঁপাতে বললাম, যাক, তোদের পাওয়া গেল তাহলে।
হীরা এক ঝটকায় নৌকাটাকে নদীর মাঝখানে নিয়ে যেতে লাগল। অন্যেরা আমাকে ঘিরে বসল। আমি ভিজে জুতো এক হাতে খুলতে খুলতে বললাম, ভেবে দেখলাম আমি একলা একলা থাকতে পারব না। তাই
সবাই খুশিতে আমাকে জাপটাজাপটি করতে লাগল, রবিন বলল, খুব ভাল করেছিস। তোকে ফেলে এসে আমার এত খারাপ লাগছিল। একটু আগে বলছিলাম ফিরে গিয়ে তোকে নিয়ে আসি।
টিপু বলল, আমার কেন জানি মনে হচ্ছিল টোপন এসে পড়বে। তোমরা তো বিশ্বাস করবে না। কিন্তু আমার সত্যি মনে হচ্ছিল।