ভাইয়া, জানালা বন্ধ করে দাও, বাতাস আসছে।
চুপ। আমি রক্তচক্ষু করে তাকালাম, কথা বলবি নে।
অন্য যেকোন সময় হলে রঞ্জু পাল্টা জবাব দিত, ঝগড়া করত আম্মাকে নালিশ করত, কিন্তু অজি কিছু বলল না। সত্যিই চুপ করে শুয়ে পড়ল।
লাইট নিভিয়ে আমি জানালার কাছে বসে থাকলাম। ওরা যখন যাবে তখন আমি দেখব। ঠাণ্ডা বাতাসটা একেবারে হাড়ের ভিতর দিয়ে কেটে কেটে যাচ্ছিল, তাই বিছানায় এসে শুয়ে পড়লাম। হু হু করে ঠাণ্ডা বাতাস যেন আমার বুকের ভিতর দিয়েই বয়ে যাচ্ছে। আমার ঘুম আসছিল না, ইচ্ছে হচ্ছিল কাঁদি। একটু পরেই রঞ্জু ঘুমিয়ে কাদা হয়ে অভ্যাসমত আমার গায়ের উপর পা তুলে দিতে লাগল আর আমি ঝটকা মেরে তার পা সরিয়ে দিতে লাগলাম।
এক সময় সবাই শুয়ে পড়ল। ঘড়ির টিকটিক ছাড়া অন্য কোন শব্দ নেই। মাঝে মাঝে সেই বিশেষ ধরনের টুকটাক শব্দ শোনা যেতে লাগল যেগুলি রাত জাগলেই শোনা যায় কিন্তু কি জন্যে হচ্ছে বোঝা যায় না। আমি দীর্ঘশ্বাস ফেলে এপাশ ওপাশ করতে লাগলাম-ঠিক সেই সময়ে জানালায় আবছা ভাবে রবিনকে দেখা গেল।
লাফিয়ে উঠতে গিয়ে সামলে নিয়ে সন্তর্পণে উঠে বসলাম। রবিন জানালা দিয়ে হাত বাড়িয়ে দিয়ে ফিসফিস করে বলল, মন খারাপ করিস নে। তারপর গলা আরও নামিয়ে বলল, নান্টু ধরা পড়ে গেছে।
সত্যি?
হ্যাঁ! ঐ শুনিস না ওদের বাসার আওয়াজ?
আমি কান পেতে শুনলাম সত্যি সত্যি খুব চেঁচামেচি হচ্ছে। রবিন বলল, যাই!
আমি শুকনো গলায় বললাম, যা!
রবিন লাফিয়ে নেমে গেল। একটু দূরে অন্যের দাঁড়িয়েছিল আমার দিকে তাকিয়ে হাত নাড়ল। আমি চুপচাপ দাঁড়িয়ে রইলাম।
.
অনেকক্ষণ পার হয়ে গেল। চোখে আর ঘুম আসে না। নান্টুদের বাসা থেকে গোলমালের আওয়াজ আর শোনা যাচ্ছে না। ঘড়ির টিকটিক শব্দ শুনতে শুনতে ভাবতে লাগলাম এখন ওরা চৌরাস্তায় পৌচেছে, একটু পরেই স্কুল পার হয়ে নদীর ঘাটে পৌঁছে যাবে। আমি কল্পনা করতে লাগলাম ওরা অন্ধকারে গুড়ি মেরে হেঁটে যাচ্ছে, নৌকায় উঠছে, সবকিছু ঠিকঠাক করে নিয়ে টেলিস্কোপে ডাকাতদের নৌকাটাকে লক্ষ্য করছে অধৈর্য হয়ে অপেক্ষা করছে কখন ওটা ছাড়বে। রবিন গালিগালাজ করছে, টিপু তার স্বভাবসুলভ শান্ত ভঙ্গিতে মাঝে মাঝে রবিনের কথার উত্তর দিচ্ছে। এক সময় নৌকা ছেড়ে দিল — অন্ধকার রাত, আকাশে তারা মিটমিট করছে, ঠাণ্ডা বাতাস হিল হিল করে বইছে, ছপাৎ ছপাৎ করে হীরা আর মিশু দাড় টানছে। অন্ধকারে আবছাভাবে তীরের গাছপালা জঙ্গল দেখা যাচ্ছে।
ভীষণ যন্ত্রণায় আমার বুকটা মোচড় দিয়ে উঠল। আমি উঠে বসলাম আর ঠিক তক্ষুনি, কিছু না ভেবেচিন্তে হঠাৎ ঠিক করে ফেললাম আমিও ওদের সাথে যাব। যেভাবেই হোক।
এতক্ষণে ওরা নিশ্চয়ই রওনা দিয়ে দেয়নি, ডাকাতদের নৌকাটা কখন ছাড়বে ঠিক কি? আর ছেড়েই যদি দেয় আমি নদীর তীরে তীরে দৌড়িয়ে ঠিক ধরে ফেলব। আমি একটু চিন্তা করে নিলাম তারপর খুব আস্তে আস্তে উঠে কাজ শুরু করলাম।
চৌকির নিচেই ক্যানভাসের খালি ব্যাগটা পেয়ে গেলাম। বালিশের নিচে ছিল সোয়েটারটা, সেটা পরে ফেললাম। অন্ধকারে হাতড়ে হাতড়ে গরম প্যান্টটা বের করতে অনেক সময় লাগল। খাকী হাফ প্যান্টটা খুঁজে বের করতেও অনেক সময় নষ্ট হল। আলো থাকলে কি সহজেই না সবকিছু পাওয়া যায়। হকি সু গুলি পরে ফেললাম, মোজা ছাড়াই। ওগুলি এই অন্ধকারে কে খুঁজে বের করবে? এখন দরকার একটা অস্ত্র, চাকু বা ঐ জাতীয় কিছু কিছু টাকা, একটা টর্চলাইট, একটা কম্বল আর ওষুধগুলি।
ওষুধের শিশিগুলি বের করার জন্যে যেই টেবিলে হাত দিয়েছি অমনি মিকচারের শিশিটা ঠক করে টেবিলে পড়ে গেল। আমি আঁতকে উঠে শিউরে উঠলাম, এখন নিশ্চয়ই কেউ না কেউ ঘুম থেকে উঠে যাবে! হলোও তাই, আব্বা পাশের ঘর থেকে জিজ্ঞেস করলেন, কে?
আমি এক মুহূর্ত দ্বিধা করে বললাম, আমি আব্বা!
ও। কি করিস?
পানি খাব। বলেই খুট করে লাইট জ্বাললাম, অন্ধকারে পানি খাওয়া স্বাভাবিক নয়। আমার কপালে তখন বিন্দু বিন্দু ঘাম জমে উঠেছে, আব্বা যদি একবার উঠে আসেন তাহলে শার্ট প্যান্ট জুতা পরা অবস্থায় দেখলে বুঝতে কিছু বাকি থাকবে না। ভাগ্য ভাল আব্বা উঠলেন না। আমি শব্দ করে পানি খেলাম, আর আলোতে পরিষ্কার সবকিছু দেখতে পেয়ে মোজা জোড়া খুঁজে বের করে পকেটে ঢুকিয়ে ফেললাম। তাক থেকে রঞ্জুর মাটির ব্যাঙ্কটা নামিয়ে ব্যাগে ভরে ফেললাম, মাস তিনেক ধরে সে ওখানে পয়সা জমিয়ে যাচ্ছে। ওষুধের শিশি, ট্যাবলেটগুলি পকেটে ভরে ফেলে আমি আবার লাইট নিভিয়ে দিলাম, পানি খেতে বেশি সময় লাগার কথা না! অন্ধকারে পা টিপে টিপে বিছানার উপর থেকে কম্বলটা নিয়ে ভাঁজ করে ফেললাম, এক হাতে ভাঁজ করা কি সোজা ব্যাপার? চাকু আর টর্চ পাওয়া গেল না কিন্তু আর দেরি করা যায় না। আমি ব্যাগটা কাঁধে নিয়ে বিদায় নেয়ার জন্যে প্রস্তুত হলাম। আমার হঠাৎ কেন জানি বুকের ভিতর ফাঁকা ফাঁকা লাগল। দরজা খোলার সময়ে এক মুহূর্তের জন্যে মনে হল যেয়ে কাজ নেই, কিন্তু মনকে শক্ত করে খুব ধীরে ধীরে নিঃশব্দে ছিটকিনি খুলে ফেললাম, ওটা আবার খোলার সময় মাঝে মাঝে শব্দ করে। তারপর একেবারে অন্ধকার রাস্তায়।
কাল ভোরে যখন দেখবে এ পাড়ার সব ছেলে উধাও তখনই সবাই বুঝে নেবে, তার উপর নান্টু তে থাকলই।