কাটেনি।
তাহলে?
ইঁদুরে খেয়ে নিয়েছে। বলে সে কাটা হাতটা দুলিয়ে হিঃ হিঃ করে হেসে উঠল।
বলো না শুনি।
বলব না। বলে এই আশ্চর্য ছেলেটা চুপ করে গেল। তারপর পা দোলাতে দোলাতে জিজ্ঞেস করল, তোরা দিনরাত গাছে বসে থাকিস?
আমি মুখ বাঁকা করে তাচ্ছিল্য করে ওকে উড়িয়ে দিলাম। বললাম, আমাদের ম্যালা কাজ। গাছে বসে থাকব কেন?
আজ যে বসে আছিস?
আজ যে ওর সাথে পরিচয় করার জন্যে বসে আছি সেটা তো আর বলতে পারি না! আমি তাই কোন উত্তর দিলাম না। বুঝতে পারলাম এ ছেলেটা ভারি পাজি হবে, আমাদের অনেক জ্বালাবে।
তোরা কি করিস? ছেলেটা আবার খোঁচাতে শুরু করল। মেয়েদের সাথে বুড়ী-চি খেলিস বুঝি? নাকি এক্কা দোকা? তারপর আবার হিঃ হিঃ করে হাসতে লাগল।
দ্যাখ নতুন এসেছিস বলে তোকে ছেড়ে দেবো ভাবিস না। আবার ওরকম খ্যাক খ্যাক করলে মেরে হাড় গুঁড়ো করে দেব। হীরা অনেকক্ষণ সহ্য করে যাচ্ছিল, এবারে একটু ধাতানি দিল।
হাড় গুঁড়ো করে দিবি বুঝি? দে না বলে সেই অবাক ছেলে হীরার কাছে এগিয়ে যায়।
হীরা হাড় গুঁড়ো করার কোন উৎসাহ দেখায় না। আস্তে আস্তে গাছ থেকে নেমে পড়ে। সাথে সাথে আমরাও, বুঝতে পারলাম এই প্রথম আমাদের বন্ধুর পর শত্রু, শত্রুর পর আবার বন্ধু আসার নিয়মটা খাটল না। এবারে শত্রুর পর আবার শত্রু চলে এসেছে। আমাদের চলে যেতে দেখে ছেলেটা গাছ থেকে চেঁচিয়ে জিজ্ঞেস করল, কোথায় যাচ্ছিস?
আমরা উত্তর না দিয়ে হাঁটতে লাগলাম।
দাঁড়া, আমিও আসি বলে এক হাতে একটা ডাল ধরে ঝুলে পড়ে সে দুই লাফে আমাদের কাছে চলে এল।
কথা বলছিস না যে?
হীরা গোঁ গোঁ করে বলল, তোকে কেউ ডাকছে না।
ছেলেটা না শোনার ভান করে পাশাপাশি হেঁটে যেতে থাকে। পথে একটা কুকুরকে ঢিল ছুঁড়ে ভয় দেখাল, একটা ছাগলের বাচ্চার পিছনের দুই পা ধরে খানিকক্ষণ দুই পায়ে হাঁটিয়ে নিয়ে বেড়াল। তারপর আবার গম্ভীর হয়ে পাশাপাশি হাঁটতে হাঁটতে এটা সেটা জিজ্ঞেস করতে লাগল। আমরা কখনো ওর কথার উত্তর দিচ্ছিলাম, কখনো দিচ্ছিলাম না, ও মোটেই সেসব খেয়াল করছিল না। সত্যি কথা বলতে কি এই হাত কাটা ছেলেটাকে আমার খারাপ লাগছিল না আর এমন কৌতূহলী হয়ে উঠছিলাম যে বলার নয়।
নান্টুদের বাসার বাইরে আমরা এসে দাঁড়ালাম। ওদের বাসার বাইরের দিকে একট ঘর সবসময় খালি পড়ে থাকত। আমরা এটাকে পরিষ্কার করে নিয়ে আমাদের হাসপাতাল খুলেছিলাম। হাসপাতাল উঠে যাবার পর আমরা যে সার্কাসের টিম খুলেছিলাম সেটার হেড অফিসও ছিল এখানে। এখন এখানে আমাদের ডিটেকটিভ এজেন্সির অফিস। হাত কাটা ছেলেটাকে এখানে নিয়ে এসে গর্বে আমাদের বুক ফুলে উঠল। ঘরের বাইরে আমাদের সাইন বোর্ড (শফিক ভাই করে দিয়েছেন, উনি যা চমৎকার ছবি আঁকেন!) সাইন বোর্ডে লেখা, ‘ “প্রাইভেট ডিটেকটিভ এজেন্সি কোঃ” শার্লক হোমস অ্যাভিনিউ’। (আমরা এই এলাকাটাকে শার্লক হোমস অ্যাভিনিউ নাম দিয়েছি-– পিয়নকে বলে দিয়েছিলাম শার্লক হোমস অ্যাভিনিউয়ে কোন চিঠি এলে যেন এ পাড়াতে নিয়ে আসে।) ছেলেটা খুব মনোযোগ দিয়ে সাইন বোর্ডটি পড়ল। আমার সন্দেহ হল হয়ত এই ছেলেটা শার্লক হোমসকে চেনে না। তাই জিজ্ঞেস করলাম, শার্লক হোমস কে জান?
ছেলেটা ঠোঁট উল্টে বলল, খুব জানি। ওর সিনেমা পর্যন্ত দেখেছি।
আমি একটু দমে গেলাম। ভেবেছিলাম শার্লক হোমসের পরিচয় দেব, ওঁর সম্বন্ধে দু একটা কাহিনী বলব, আর নাচুনে পুতুলের গুপ্ত সংকেত যে আমরাও জানি সেটাও জানিয়ে দেব। কিন্তু ছেলেটা নাকি শার্লক হোমসের সিনেমাও দেখেছে!
আমি গম্ভীর হয়ে নান্টুকে বললাম তালাটা খোল তো। দরজায় একটা নাম্বার লক লাগানো, নাম্বার মিলিয়ে খুলতে হয়। নাম্বারটা আমরা ছাড়া পৃথিবীর আর কেউ জানে না। ‘প্রাইভেট ডিটেকটিভ এজেন্সি কোঃ’র সব সদস্যদের প্রথমেই প্রতিজ্ঞা করতে হয় কোন অবস্থাতেই তারা কাউকে এ নাম্বার জানাবে না। এই ঘরে আমাদের যাবতীয় গোপন তথ্য। আমরা তালা খুলে ভিতরে ঢুকে জানালা খুলে দিলাম। ভিতরটা দারুণ ভাবে সাজানো। একটা টেবিল, সামনাসামনি দুটো চেয়ার, একটা টুল, একটা বাক্স (অস্ত্রশস্ত্র বোঝাই); দেয়ালে দুর্ধর্ষ ডিটেকটিভদের ছবি— শার্লক হোমস, জেমস বণ্ডেরও আছে। তাকে সেরা সেরা সব ডিটেকটিভ বই। বাংলাগুলো সবাই তিন চারবার করে পড়েছি, ইংরেজিগুলো বড় হয়ে পড়ব।
কি করিস এইখানে। ছেলেটা ভুরু কুঁচকে জিজ্ঞেস করল।
এটা আমাদের ডিটেকটিভ ক্লাব। এ পাড়ায় যত খুন ডাকাতি হয় সব আমরা খুঁজে বের করি।
ইহ! ছেলেটা অবিশ্বাসের শব্দ করল।
বিশ্বাস করলি না? তুই রুনুকে জিজ্ঞেস করে দেখ, ওর আংটি হারিয়ে গেলে আমরা খুঁজে বের করে দিয়েছি কিনা!
.
ছেলেটা চুপ করে থাকল। রুনুর আংটি হারিয়ে গেলে আমরা সবাই সত্যি সত্যি খুঁজে বের করে দিয়েছিলাম। কিন্তু আমাদের এতো ডিটেকটিভের বিদ্যে সেবার কাজে লাগেনি। রুনু খেলতে খেলতে হারিয়ে ফেলেছিল, তাই বোঝাই যাচ্ছে ওটা মাঠে কোথাও পড়েছে। আমরা তন্ন তন্ন করে খুঁজে বের করে ফেললাম অবিশ্যি কাউকে যখন গল্পটা বলি তখন এমন ভাব দেখাই যে ভীষণ মাথা খাটিয়ে ওটা বের করতে হয়েছে!
এরপরে অবিশ্যি আমাদের হাতে আর কোন কেস আসেনি। এ পাড়ায় একটাও খুন হয় না, এমন কি একটা বিড়াল মারা যায় না। সেবার পল্টুদের একটা বিলাতী মোরগ মারা গেল। আমরা সবাই সন্দেহ করেছিলাম ওটা নিশ্চয়ই কোন অপরাধী মারাত্মক বিষ খাইয়ে মেরে ফেলেছে। আমরা যখন অপরাধীকে সন্দেহ করে প্রায় বের করে ফেলেছিলাম তখন জানা গেল আরেকটা মোরগ মারা গেছে, অন্যগুলিও ঝিমাচ্ছে। ওদের নাকি রানীক্ষেত রোগ হয়েছে। আমাদের তখন এতো মন খারাপ হল!