তারপর ওরা আর দেরি করেনি গুঁড়ি মেরে সরে এসে সাইকেলে চড়ে পালিয়ে এনেছে।
রিভলবারটা? আমি জিজ্ঞেস করলাম।
নিয়ে এসেছি।
নিয়ে এসেছিস? আমরা অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করলাম, কই? দেখা দেখি।
রবিন এদিক সেদিক তাকিয়ে কোমর থেকে রিভলব্যরটা বের করল, প্যান্টের ভিতর খুঁজে রেখেছিল। দেখি দেখি বলে সবাই হাত বাড়িয়ে দিল। টিপু বলল, খবরদার গুলি ভরা আছে কিন্তু।
আমরা হাতে নিয়ে দেখলাম, বেশ ভারি। এখানে অন্ধকার ঠিক দেখা যাচ্ছিল না। মিশু হাতে নিয়ে কোথায় চাপ দিয়ে কড়াৎ করে খুলে ফেলল, অমনি গুলি গুলো খুলে মাটিতে ছড়িয়ে পড়ল। আমরা হা হা করে উঠতেই মিশু বলল, ঠিক আব্বারটার মতো।
আমাদের খেয়াল হল মিশুর আব্বার রিভলবার আছে, তিনি এখানকার ডি এস পি। মিশু রিভলবার খুলে গুলি ভরতে পারে। সে দেখিয়ে দিল কিভাবে সেফটি ক্যাচ অফ করে ফেলার পর আর গুলি করা যায় না, আবার অন করতেই কিভাবে গুলি করার জন্যে প্রস্তুত হয়ে ওঠে।
আমরা গুলিগুলো খুলে নিয়ে ফাঁকা রিভলবার দিয়ে গুলি করার চেষ্টা করলাম। ট্রিগারটা ভীষণ শক্ত, রবিন ছাড়া আর কেউ এক হাতে গুলি করতে পারল না। ওর সব কাজ এক হাতে করতে হয় তাই ওর হাতের আঙুলে দারুণ জোর।
বিভলবারটা রবিন আবার লুকিয়ে ফেলল কেউ দেখলে কেলেঙ্কারি হয়ে যাবে। আমি জিজ্ঞেস করলাম, এখন কি করবি? ডাকাতদের কথা থানায় –
থানায় বলে লাভ নাই। আমাদের কথা কেউ বিশ্বাস করবে না।
রিভলবারটা দেখাব।
তাহলে তোমাকেই ধরবে। বেআইনী অস্ত্র হাতে থাকলেই দশ বছরের জেল।
তাহলে উপায়? আর ওরা তো এতক্ষণে হয়তো রওনাই দিয়ে দিয়েছে।
সবাই চুপ করে থাকল! আমি বললাম তাহলে কি করা যায় কল!
রবিন কাটা হাতটা নাড়তে লাগল, সমস্যায় পড়ে গেলে ও সাধারণতঃ যা করে।
কি হল?
গলা খাকারি দিয়ে রবিন বলল, আমরা ঠিক করেছি টিপুর নৌকা দিয়ে আমরা ডাকাত দলটার পিছু পিছু যাব।
শুনে আমার বুকের ভিতর রক্ত ছলাৎ করে উঠল। উত্তাল নদীতে ডাকাত দলের পিছনে আমরা নৌকা নিয়ে ছুটে যাচ্ছি, প্রচণ্ড অট্টহাসির শব্দ, তার সাথে চ্যাট ট্যাট ট্যাট করে গুলি! পালে বাতাস লেগে নৌকা পানির বুক চিরে উড়ে চলছে, সবার চুল উড়ছে বাতাসে, তার মাঝে যুদ্ধ! মুহূর্তে আমার চোখের সামনে দিয়ে দৃশ্যগুলি ভেসে। উঠল। কিন্তু সাথে সাথেই আমার মনে পড়ল আমার বাম হাতটা ভাঙা, প্লাস্টার খুলবে আরো চৌদ্দদিন পরে, মনে পড়ল আমি জ্বরে কাহিল, ঠাণ্ডা লাগানো নিষেধ, সাথে সাথে খুকখুক করে কেশেও উঠলাম।
আমি সব ভুলে গিয়ে বললাম, তাহলে আর সময় কই? আমাদের রেডী হতে হবে না?
রবিন কিছু বলল না, পা দিয়ে মাটিতে দাগ কাটতে লাগল।
কি ব্যাপার?
তাহলে শোন—রবিন আবার গলা খাকারি দিল, তোকে আমাদের সাথে নিচ্ছি না।
কেন? আমার গলার আওয়াজ আর্তনাদের মত শোনালেও আমি বুঝতে পারলাম আমাকে সত্যি ওরা নেবে না, আর নেয়া সম্ভবও না। এক হাত ভেঙে পঙ্গু, এখনও জ্বর ভাল করে সারেনি, অনিয়ম করলে মারা যাব, ডাক্তার চাচা বলে গেছেন। তবু ব্যাপারটা ভাবতে গিয়ে আমার বুকটা ফাঁকা ফাঁকা লাগতে লাগল। রবিন, মিশু, টিপু, সলিল, হীরা, কাসেম, নান্টু সবাই যাবে। ডাকাত দলের পিছু পিছু ধাওয়া করে বেড়াবে, আর আমি, এই টোপন কিনা বাসায় বসে থাকব? ভাবতেই দুঃখে দম বন্ধ হয়ে এল।
আমি যাবই। কোন যুক্তি ছাড়াই আমি গোঁয়ারের মত চেঁচিয়ে উঠলাম।
তখন সবাই মিলে আমাকে বোঝাতে বসল। প্রথমে কেউই কথাটি বলতে পারছিল না, কিন্তু একবার বলার পর ব্যাপারটি খুব সহজ হয়ে গেল। টিপু বলল, নৌকা ডুবে গেলে সাঁতরাতে পারবে না, তোমার হাত প্লাস্টার করা।
আর রবিনের যে হাতই নেই!
আমার তো অভ্যাস হয়ে গেছে। এক হাতেই আবার সাঁতরানো শিখেছি! তোর হাত ভেঙেছে মাত্র সেদিন, এখনো হাড় জোড়া লাগেনি।
আর তোর অসুখও কমেনি—হীরা বলল, ঠাণ্ডা লেগে মরে যাবি।
এখনই খুকখুক করে কাশছিস।
হাতটা ধরে নান্টু বলল, শরীরে এখনো অল্প অল্প জ্বর। তুই থাক টোপন, আমরা যাই।
দুদিনের বেশি লাগবে না। আমরা এসে পড়ব।
এর পরের বার নিশ্চয়ই তোর অসুখ থাকবে না, তখন সবাই মিলে যাব।
আর কাল যখন হৈ চৈ পড়ে যাবে তুমি বুদ্ধি করে সামলে নিতে পারবে। সবাই তো তোমার কাছেই আসবে।
বলবি পিকনিকে গেছি, এসে পড়ব।
আরো সব কথা সবাই বলতে লাগল, আমি কিছু শুনতে পাচ্ছিলাম না। আমি বুঝতে পারলাম সত্যি ওরা আমাকে নেবে না। দুঃখে অভিমানে চোখে পানি এসে গেল। অন্ধকার তাই কেউ টের পেল না।
আমি মাথা নিচু করে ফিরে এলাম। সবাই বাসার দরজা পর্যন্ত এগিয়ে দিল। ওদেরও দুঃখ লাগছিল কিন্তু তাতে আমার দুঃখ কিভাবে কমবে? আমি ঢোক গিলে চোখ মুছে নিলাম। কি হবে দুঃখ করে?