ঠিক এই সময় একটা অঘটন ঘটল। দেয়াল থেকে পড়ে আমার বাম হাতটার কনুইয়ের খানিকটা নিচে ভেঙে গেল। সেদিন দুপুরে আমরা বড়ই খাচ্ছিলাম। আমি বসেছি দেয়ালের উপর, দু পকেট বোঝাই কাঁচা বড়ই, আমার বাম হাতে ঝাল মেশানো লবণ। এমন সময় সাঁই করে একটা কালো ভোমরা মাথার কাছে দিয়ে উড়ে গেল। আমি মাথা নিচু করে তাল সামলানোর চেষ্টা করতে গিয়ে প্রায় পড়ে যাচ্ছিলাম, সামলে উঠে কোনমতে ঠিক হয়ে বসলাম। ঠিক সেই মুহুর্তেই কথা নেই বার্তা নেই আমি কি ভাবে জানি পিছন দিকে পিছলে পড়ে গেলাম। ছয় সাত ফুট উঁচু দেয়াল, মাখা মাটিতে ঠুকে যাবে তাই হাত পিছনে দিয়ে তাল সামলানোর চেষ্টা করলাম আর কি আশ্চর্য! হাতটা মট কর ভেঙে গেল।
রবিন পরে বলেছিল আমি যখন হাত তুললাম তখন হাতটা নাকি উল্টো দিকে ভাঁজ হয়ে যাচ্ছিল। যন্ত্রণায় আমি চিৎকার করে উঠলাম, আরেকটু হলে কেঁদেই ফেলতাম, কিন্তু ঠিক সেই সময়ে কোথা থেকে পাড়ার মেয়েগুলো ছুটে এল।
কান্নাটাকে ঢোক গিলে ফেলে মুখ বিকৃত করে আমি ডান হাত দিয়ে বাম হাতটা ধরলাম। ভিতরে কোথায় কি লেগে ঝনঝন করে সমস্ত শরীর যন্ত্রণায় থরথর করে কেঁপে উঠল। রবিন আমার উপর ঝুঁকে পড়ে বলল, কিচ্ছু ভয় নেই, হাড়টা ভেঙে গেছে! ঠিক হয়ে যাবে। তারপর হীরাকে বলল, দৌড়ে যা শফিক ভাই বা অন্য কোন বড় কাউকে ডেকে আন। টোপনকে হাসপাতালে নিতে হবে।
সবাই, বিশেষ করে মেয়েরা ফ্যাকাসে মুখে আমার দিকে তাকিয়েছিল। শুধু ওদের দেখানোর জন্যেই আমি বললাম, আমি নিজেই পারব। তারপর দাঁতে দাঁত চেপে প্রচণ্ড যন্ত্রণা সহ্য করে উঠে দাঁড়ালাম।
.
হাসপাতালে রবিনের আব্বা গম্ভীর মুখে এক্স-রে করলেন। হাতটা তখন কালচে হয়ে ফুলে উঠেছে। পনেরো মিনিটের ভিতর এক্স-রে প্লেট পাওয়া গেল। দেখা গেল দুটো হাড়ই ভেঙেছে। কজি থেকে কনুই পর্যন্ত যে দুটো হাড় থাকে, ওটা আমি তখনই প্রথম জানলাম।
ডাক্তার চাচা খানিকক্ষণ এক্স রে প্লেটটা লক্ষ্য করে আমার কাছে এগিয়ে আসলেন। তারপর এক বিচ্ছিরি ঘটনা ঘটল। হ্যাঁচকা টান দিয়ে হাতটা সোজা করে আবার ভাঁজ করে ভীষণ নিষ্ঠুরভাবে ডাক্তার চাচা কি যেন করতে লাগলেন। শফিক ভাই আমাকে শক্ত করে ধরে রাখলেন। কাঁদবো না কাঁদবো না করেও আমি ঠোঁট কামড়ে কেঁদে ফেললাম।
পরে যখন প্লাস্টার অফ প্যারিসের গুঁড়ো মাখানো ব্যাণ্ডেজ দিয়ে পেঁচিয়ে পেঁচিয়ে প্লাস্টার করে দেয়া হল তখন নেহায়েত মন্দ লাগছিল না। ধবধবে সাদা প্লাস্টারের উপর ডাক্তার চাচা তারিখ লিখে দিয়ে আমার পিঠ চাপড়ে বললেন, ব্রেভ বয়। ওয়েল ডান।
হাতটা ভেঙে যাবার পর প্রথমে খুব মন খারাপ হয়ে গিয়েছিল, পরে দেখা গেল ব্যাপারটা সেরকম খারাপ না। আব্বা তখন তখনই পাঁচটা টাকা দিয়ে দিলেন, আম্মা একটা রংয়ের বাক্স কিনে দেবেন বললেন। অন্যেরা সবাই আমাকে হিংসে করতে লাগল! প্লাস্টার করা হাত নিয়ে আমার স্বাধীনতা অনেকটুকু কমে গেল ঠিকই কিন্তু কয়েকদিনেই অভ্যাস হয়ে গেল। রবিন এক হাতে সব কাজ কিভাবে করে ফেলত এতদিনে আমি বুঝতে পারলাম!
.
ডাকাত সর্দারের ঝোঁকটা কেটে যাবার পর আমরা ঈদের জন্যে ব্যস্ত হয়ে পড়লাম। ঈদ যতই কাছে আসতে লাগল দিনগুলি যেন ততই লম্বা হয়ে যেতে লাগল। কিন্তু ঈদের দিনটা শেষ হয়ে গেল কিছুক্ষণের ভিতর! ঈদের পর দিনগুলি কাটতে লাগল খুব খারাপ ভাবে। স্কুল খুলতে দেরি নেই আমাদের সবার ভিতরেই একটু অস্বস্তি, চাপা ভয় আর নিরানন্দের ভাব। এর ভিতর আবার একদিন আমার গা কেঁপে জ্বর এল। দুদিন ভূগেই ভীষণ দুর্বল হয়ে গেছি, চুপচাপ বারান্দার ইজি চেয়ারে বসে থাকি। সব মিলিয়ে ভয়ানক খারাপ যাচ্ছে সময়টা।
ঠিক সেই সময়ে আমাদের জীবনের সবচেয়ে ভয়ানক ঘটনাটা ঘটল।
.
আমি সারাদিন চুপচাপ শুয়ে বসে থেকে বিরক্ত হয়ে সন্ধেবেলা একটা গল্পের বই নিয়ে বসেছি। কাহিনীটা খুব জমে উঠেছে—কিভাবে সময় কেটে যাচ্ছিল টের পাচ্ছিলাম না। হঠাৎ এক সময় রবিন এসে হাজির। আমার কানের কাছে মুখ নামিয়ে। বলল, একটু বাইরে আয়।
কোথায়?
আয় না! ও অধৈর্য হয়ে ছটফট করে উঠল।
আম্মা বকবে, ঠাণ্ডা লাগানো নিষেধ।
সে আমি জানি না, রবিন ফিসফিস করে বলল, ব্যাপার আছে! তাড়াতাড়ি
আমি আম্মাকে কিছু না বলে চুপি চুপি বাইরে চলে এলাম। পেয়ারাতলায় গিয়ে দেখি সবাই দাঁড়িয়ে আছে। এমন কি এত রাত্তিতে টিপুও আছে, পাশে একটা সাইকেল দেয়ালে হেলান দিয়ে রেখেছে। আমাকে দেখে ওরা সবাই ফিসফিস করে উঠল।
সবাই একসাথে বোঝাতে চাইছিল বলে আমার বুঝতে একটু দেরি হল। শেষ পর্যন্ত বুঝতে পারলাম এইমাত্র টিপু আর রবিন খবর এনেছে সেই ভয়ানক ডাকাত সর্দারটা হাতে গুলি লেগেছিল বলে হাতটা কেটে ফেলেছে, সে তার দলবল নিয়ে নদীতে অপেক্ষা করছে। রাত গভীর হলেই রওনা দিয়ে দেবে।
আমি ভীষণ অবাক হয়ে বললাম, তোরা কেমন করে জানলি?
সবাই হড়বড় করে বলার চেষ্টা করল, হীরার গলার স্বর উঠল সবচেয়ে উপরে এবং আমি কিছুই বুঝতে পারলাম না।
শ–স-স— রবিন ঠোটে আঙুল দিয়ে চুপ করতে বলে। সবাই চুপ করতেই টিপু আমাকে ব্যাপারটি বুঝিয়ে দেয়। কোন জিনিস টিপুর মত গুছিয়ে কেউ বলতে পারে না। হীরা হলে বলতে বলতে দশবার হাসতো, চারবার আগেরটা পরে, আর পরেরটা আগে বলে ফেলত, সবশেষে কিছু বোঝাতে না পরে ঝগড়া করে ফেলত।