.
স্কুল ছয় পিরিয়ড হয়ে ছুটি হয়ে গেল, স্যারদের নাকি কি একটা মিটিং আছে। আমার কাছে লক্ষণটা বড় ভাল মনে হল। এমনিতেই আমাদের কাজ শুরু করার জন্যে বেশ সময় দরকার ছিল। তার উপর শেষ ক্লাসটা ছিল ইতিহাস স্যারের, ক্লাসটা করা লাগল না। ইতিহাস স্যারটা পড়া না পারলে এমন মার মারতে পারে! (ছেলেরা বলে স্যারের বুকে নাকি লোম নাই, বুকে লোম না থাকলে লোকেরা নাকি নিষ্ঠুর হয়)।
সকাল সকাল ছুটি পেয়ে আমরা সবাই যে যার কাজে চলে গেলাম। নান্টু তার বাসায় বই রেখে টেলিস্কোপটা নিয়ে টিপুর সাথে গেল। ওরা গুজগুজ করে সারাক্ষণ একটা রকেট বানানোর কথা বলছিল। কথাবার্তা শুনে মনে হচ্ছিল ডাকাত ধরায় ওদের উৎসাহ নেই, রকেট বানানোই যেন বেশি দরকার।
.
সলিল আর মিশু বারান্দায় বসে বসে খবরের কাগজ খুটে খুটে পড়তে লাগল। আমি হীরা আর রবিন কিভাবে কাজ শুরু করব ঠিক করার জন্যে এক জায়গায় বসলাম। কাসেম শুধু থাকতে পারল না, আজ নাকি ওর ওদের খালার বাসায় যাওয়ার কথা।
অনেক তর্কবিতর্ক করে আমরা প্রথমে গেলাম হাসপাতালে।
রবিনের আব্বা হাসপাতালের ডাক্তার, রবিন ওখানকার সবাইকেই চেনে। জিজ্ঞেস করে জানা গেল হাতে জখম এমন কোন রোগী এখানে আসেনি।
এরপর আমরা একজন একজন কর সব কয়জন ডাক্তারের কাছে গেলাম, নানা ভাবে জানতে চেষ্টা করলাম তারা কোন হাতে জখম এমন রোগীর চিকিৎসা করেছে কি না! আমাদেরকে কেউ এতটুকু পাত্তা দিল না। কম্পাউণ্ডার অর কর্মচারীরা আমাদের কথার উত্তর দেয়া দূরে থাক, মাঝে মাঝেই ধমকে দিল। তার মাঝেও আমরা চেষ্টা করলাম আসল খবরটি বের করে নিতে। খবর পাওয়া গেল খুব কম আর যেটুকু পাওয়া গেল সেটুকুও খুব হতাশাব্যঞ্জক।
ডাকাত সর্দারটি যে কিভাবে বাতাসে উবে গেল আমরা বুঝতেই পারলাম না। লাভের মাঝে লাভ হল হীরা একটা ওষুধের দোকানের কর্মচারীর সাথে ঝগড়া করে বলে আসল রাতে ঢিল মেরে সব ওষুধের শিশি গুঁড়ো করে দেবে।
.
আমরা ফিরে এসে দেখি অন্য সবাই মিলে কিংকুইন খেলছে। দেখেই আমাদের মেজাজ খারাপ হয়ে গেল। আমরা এত কষ্ট করে ঘুরোঘুরি করে খবরাখবর জোগাড় করার চেষ্টা করছি আর তারা মজা করে খেলছে? হীরা মুখ চোখ লাল করে ওদের গালি দিল, তোদের কাজ করেছিস কিছু? খুব যে খেলা শুরু করেছিস?
ওরা খেলায় এত ব্যস্ত ছিল যে আমাদের লক্ষ্যই করল না। সলিল তো ভুল করে হীরার পিঠে টেনিস বলটা দড়াম করে মেরেই বসল—তারপর বিচ্ছিরি মারামারি।
সবাইকে ঠাণ্ডা করে বসিয়ে দিয়ে আমরা কাজ শুরু করলাম।
ডাকাতটা ধরতে পারলি? মিশু জিজ্ঞেস করল।
ডাকাত তো রসগোল্লাটা! আমি উল্টো ধমক দিলাম, তোমার জন্যে রাস্তার মোড়ে বসে আছে কি না।
মিশু লজ্জা পেল। বিড়বিড় করে কি জানি বলে থেমে গেল। আমরা আমাদের পুরো তিক্ত অভিজ্ঞতাটা বর্ণনা করলাম। শুনে সবাই দমে গেল।
যাই হোক, রবিন মিশুকে জিজ্ঞেস করল, তোর কাজ কতদূর?
কমপ্লিট। বলে সে পকেট থেকে একটা ফুলস্ক্যাপ কাগজ বের করে দিল। সেখানে মোট আঠারোটা ডাকাতির খবর। চট্টগ্রামের ধূমচাচিয়া গ্রামের হোসেন মিয়ার বাড়ি থেকে শুরু করে দিনাজপুরের মেথিকান্দা গ্রামের হরেন পালের দোকান লুটের খবর পর্যন্ত আছে। সবচেয়ে পুরানোটি একমাস এগারো দিন আগেকার আর সবচেয়ে নতুনটি গত সপ্তাহের। সবমিলিয়ে মানুষ মারা গেছে ছয়জন, আহত হয়েছে পনেরোজন, ডাকাত ধরা পড়েছে সাতজন। ডাকাতি হয়েছে আনুমানিক তিন লক্ষ দুই হাজার সাত শত বাইশ টাকা! মিশু ছক কেটে পরিষ্কার হাতের লেখায় সবকিছু সুন্দর করে লিখে এনেছে, দেখে একনজরেই সবকিছু বোঝা যায়। কিন্তু আমাদের যে খবরটি দরকার, আশে-পাশে কোথাও আজকালের ভিতর ডাকাতি হয়েছে কিনা এবং ডাকাতি করতে গিয়ে ডাকাত গুলি-টুলি খেয়েছে কিনা, সে খবরটি কোথাও নেই। মিশু বলল সেরকম কোন ঘটনা ঘটলেও সামনের সপ্তাহের আগে সেটা জানা যাবে না – সবকিছু দেরি করে ছাপানো খবরের কাগজের অভ্যাস, এতক্ষণ খবরের কাগজ ঘেঁটে সে এইটুকু মাত্র জানতে পেরেছে।
এরপরে নান্টু আর টিপুক জিজ্ঞেস করা হল তাদের কাজ কতদূর। ওরা সাফ বলে দিল যে ওরা কোনো নৌকা দেখেনি।
কোনো নৌকাই দেখিসনি?
তা দেখেছি। পাট নিয়ে যাচ্ছে মোটা মোটা নৌকা, খেয়াপার করছে আর জেলে নৌকা জাল ফেলে রাখছে!
আমরা হতাশ হয়ে পড়লাম। এরকম একটা দুর্ধর্ষ ডাকাত যদি হাতের কাছে এসে ফসকে যায়, তাহলে কি রকম লাগে? তার উপর আমরা এতোগুলো ছেলে!
আমরা অনেকক্ষণ মনমরা হয়ে বসে থেকে আবার ধীরে ধীরে চাঙা হয়ে উঠলাম। ডাকাতটার যে অবস্থা বেশ কয়দিন তাকে এখানে থাকতে হবে, আমরা তার মাঝে একটা বুদ্ধি ঠিক বের করে ফেলব। আর সবচেয় বড় কথা কয়েকদিনের ভিতরেই স্কুল ছুটি হয়ে যাবে। রোজার ছুটি। পরীক্ষাও হয়ে গেছে, পড়াশোনার ঝামেলা নেই। আমরা দিনরাত চব্বিশ ঘণ্টা খেটে ঠিক ডাকাতটাকে ধরে ফেলব।
০৯. অঘটন
ছুটির দিনগুলি কেটে যেতে লাগল খুব তাড়াতাড়ি কিন্তু আমরা ডাকাত সর্দারের আর কোন হদিসই খুঁজে পেলাম না। আমরা চেষ্টা করলাম শহরের সব কয়জন ডাক্তারকে চোখে চোখে রাখতে কিন্তু সেটা সহজ নয়। রোদে ঘুরে ঘুরে আমাদের চেহারা খারাপ হয়ে উঠতে লাগল আর ঘন ঘন বাসায় বকাঝকা পিটুনি খেতে লাগলাম। শেষে সবাই বিরক্ত হয়ে উঠলাম, মনে হতে লাগল ডাকাত সর্দারকে ধরে কাজ নেই অন্য কিছু করা যাক।