কি? আমরা চমকে উঠে জিজ্ঞেস করলাম, কি?
সলিল নদীর তীরে খানিকটা দূরে আঙুল দিয়ে দেখাল। আবছা অন্ধকার তার মাঝে খানিকটা অন্ধকার জমাট বেঁধে আছে। ভাল করে লক্ষ্য করে দেখি জমাট অন্ধকারগুলি অল্প অল্প নড়ছে। ঈষৎ আলো হঠাৎ জ্বলে উঠে আবার নিভে গেল।
কি ওখানে? নান্টুর গলার স্বরে বুঝতে পারলাম ও ভয় পেয়েছে।
কয়েকজন মানুষ নৌকা থেকে নামছে। রবিন আন্দাজে ঢিল ছুঁড়ল। আমরা আরো ভাল করে তাকালাম। নদীর তীর যখন নৌকা হওয়াই স্বাভাবিক, কিন্তু ঐ বড় জমাট অন্ধকারটা কিসের?
চল যাই। রবিনের কথায় আমরা চমকে উঠলাম।
কোথায়?
ওখানে, দেখে আসি।
পাগল। কেন না কে– আমাদের খুন করে রেখে যাবে।
ইহ! আমরা এতোজন ছেলে।
ওরা যদি আমাদের থেকে বেশি হয়?
আমরা লুকিয়ে থাকব দেখতে পাবে না তো। রবিন ফিসফিস করে বলল, উঁচু সড়কটার পাশে উবু হয়ে বসে থাকব।
না, না। নান্টুর মোটেই উৎসাহ নেই।
আরে চল না— রবিনের উৎসাহ দেখে আমাদের রাজি হতে হল। ওর মাথাটা সাফ, আমাদের ভিতর যাদের শার্ট সাদা সেগুলি খুলে হাতে নিতে বলল, অন্ধকারে সেগুলি অনেকদূর থেকে দেখা যায়। আমরা সাদা শার্টগুলি খুলে গুটি পাকিয়ে হাতে নিয়ে নিলাম। তারপর গুড়ি মেরে এগিয়ে যেতে লাগলাম।
আমরা যেদিক দিয়ে যাচ্ছি সেটা রাস্তা নয়, রাস্তার পাশে শুকনো নালাটা। খানাখন্দ, ইট পাথর জঙ্গল, গোবর সব মাড়িয়ে আমরা যতটুকু সম্ভব কাছে গেলাম উত্তেজনায় আমাদের বুক ঢিপ ঢিপ করছে। যেটাকে জমাট বাধা বড়োসড়ো খানিকটা অন্ধকার দেখা যাচ্ছিল সেটা আসলে একটা রিক্সা। নদীর তীরে বালুর উপর দিয়ে ছেড়ে এতদূরে রিক্সা কেন এনেছে বুঝতে পারলাম না। রিক্সাটা নদী থেকে অল্প দূরে। নদীতে একটা নৌকা। টিপুর নৌকাটার মতোই তবে আরো সরু আর অল্প কিছু লম্বা। আমরা কয়েকজন লোকের চাপা গলার স্বর শুনতে পেলাম, কিন্তু কি বলছে বুঝতে পারলাম না।
হঠাৎ একটা চাপা আর্তনাদ শোনা গেল। মনে হল কাউকে যেন কেউ ছোরা মেরেছে। আমরা ভয়ে সিঁটিয়ে গেলাম। উঠে দৌড় দেব কিনা বুঝতে পারছিলাম না ঠিক সেই সময় গোঙানোর আওয়াজ শোনা গেল, কে যেন গোঙাতে গোঙাতে বিশ্রী ভাষায় গালি দিচ্ছে।
একটু পরেই দেখা গেল নৌকা থেকে একজন লোককে কয়েকজন ধরাধরি করে নামাচ্ছে। বোঝা যাচ্ছে লোকটি অসুস্থ, এতক্ষণ ধরে সেই গোঙাচ্ছিল, সেই গালিগালাজ করছিল।
হারামজাদা, ঠিক করে ধরতে পারিস না? লোকটা আবার কাকে গালি দিল। অসুস্থ অবস্থাতেই এর এতো দাপট? আমরা ভারি অবাক হলাম। কে একজন বেকায়দা ধরতেই লোকটা আবার চাপা আর্তনাদ করে উঠল শুয়োরের বাচ্চা, কুত্তার বাচ্চা মেরে ফেলল! আঃ! আহ—
বুঝতে পারলাম কোথাও ওর মারাত্মক জখম আছে। অন্ধকারে বোঝা যাচ্ছে না ঠিক কোথায়। ওকে টেনে রিক্সায় তোলা হল। রিক্সায় উঠে গলা নামিয়ে বলল– কিন্তু আমরা ঠিকই শুনতে পেলাম, কেউ দেখেনি তো?
না।
অন্ধকারে আমাদের হাত পা মিটিয়ে গেল।
একটা বিড়ি দে তো। আবার লোকটার গলার আওয়াজ শোনা গেল। তাকে একটা বিড়ি দেয়া হল। ম্যাচ আলতেই দেখলাম নিষ্ঠুর উৎকট একটা মুখ, লম্বা লম্বা চুল মিশমিশে কাল, বাম হাতে কাপড় জড়ানো ভাঁজ করে বুকের কাছে রাখা, কাপড়ে রক্তের কালচে ছোপ। একটা পাও মনে হল কাপড়ে জড়ানো! দেখে আমাদের বুকের ভিতর গুরগুর করে উঠল।
এই ইয়াসিন, চল। একটা লোক যার নাম ইয়াসিন, রিক্সাকে টেনে নিতে থাকে অন্যের পিছনে ঠেলতে থাকে আর ঐ বীভৎস দর্শন ভয়াবহ লোকটা রিক্সার ঝাঁকুনির সাথে সাথে আঃ উঃ করতে থাকে।
আমরা আবার পা টিপে টিপে শ্মশানের কাছে ফিরে এলাম তারপর একটি কথাও না বলে ভয়ে ভয়ে বাসায়। পথে প্রতিমুহূর্তে মনে হচ্ছিল সেই দলটার সাথে দেখা হয়ে যাবে আর ওরা হা হা করে আমাদের ঘাড়ে ঝাঁপিয়ে পড়বে।
.
লোকটা হচ্ছে একটা ডাকাত সর্দার। কথাটা রবিন প্রথম বললেও আমরাও সবাই মনে মনে এটি ভাবছিলাম। ভীষণ দর্শন সব লোকদেরই আমাদের ডাকাত বলে ভাবতে ইচ্ছে করে আর এর তো কোন প্রশ্নই ওঠে না। কি ভয়ানক সন্দেহজনক কথাবার্তা, কাজকর্ম, কি ভয়াবহ চেহারা, বাঁ হাতে জখম, রক্তের ছোপ এ যদি ডাকাত না হয় ডাকাত কে হবে?
ওকে আমরা ধরিয়ে দেব।
কেমন করে? সলিল জিজ্ঞেস করে, চলেই তা গেল রিক্সা করে।
খুঁজে বের করব। কোথায় গেছে তো বোঝাই যাচ্ছে।
কোথায় গেছে?
ডাক্তারের কাছে। রবিন বিজ্ঞের মত বলল, দেখিসনি হাতে গুলি লেগেছে? এবারে হাত কেটে ফেলতে হবে। রবিন একটু হাসল, তারপর নিজের কাটা হাতটি নাড়ল।
গুলি? হীরা সন্দেহ প্রকাশ করল। গুলি তুই কেমন করে বুঝলি? হয়তো ফোঁড়া উঠেছে
আরে ধেৎ গাধা! ফোঁড়া উঠলে এরকম হয়? রবিন খিকখিক করে হাসল। এটা গুলি ছাড়া আর কিছু নয় কোথায় ডাকাতি করতে গিয়েছিল আর বেকায়দায় পড়ে গুলি খেয়েছে।
পেপারে পাওয়া যাবে তাহলে আমি একটু ভেবে বললাম, কাল পরশুর পেপারে দেখতে হবে আশে-পাশে কোথাও ডাকাতি করতে গিয়ে কোন ডাকাত দল গুলি খেয়েছে কি না।
ঠিক বলেছিস! রবিন আমার ঘাড়ে থাবা দিল। বলল একটা প্ল্যান করে কাজ করতে হবে। তারপর বিড়বিড় করে বলতে লাগল, নৌকাটার উপর নজর রাখতে হবে, আবার কোথায় না কোথায় চলে যায়। তারপর গলার স্বর নামিয়ে বলল, আর সবাই শোন, কাউকে কিছু বলবি না কিন্তু খবরদার।