তবুও রাত আটটার আগে আমরা পৌঁছতে পারলাম না। বুক ঢিপঢিপ করতে করতে যখন আমরা বাসায় ফিরে আসছিলাম তখন এশার নামাজের আযান হচ্ছে। রবিন একটু চিন্তিত মুখে বলল, নৌকায় আরও দুটো দাঁড় বসাতে হবে!
হীরা মুখ খিঁচিয়ে বলল, আগে দ্যাখ বাসায় গেলে হাড় একটা আস্ত থাকে কি না!
নাই বা থাকল রবিন তুড়ি মেরে উড়িয়ে দিল!
০৭. ধূমকেতু
প্রথমে নান্টু বলল, ভোররাতে আকাশে ধূমকেতু দেখা যায়। পরে টিপু বলল সে নাকি দেখেছেও। ধূমকেতুর নামও বলল- ইকেয়াসেকী। পরে সবাই বলল তারা সবাই নাকি দেখেছে। মাথাটা নাকি ছোট্ট আর লেজ বিরাট লম্বা। আমরাও দেখার জন্য ব্যস্ত হয়ে পড়লাম কিন্তু ভোররাতে ঘুম থেকে ওঠা কি সোজা কথা? আম্মাকে খুব করে ডেকে তুলতে বলে রাখলাম। আম্মাও একদিন ডাকতে শুরু করলেন। কিন্তু লেপের তলা। থেকে বের হতে এত বিরক্তি লাগল কি বলব। আম্মা বললেন, এই টোপন, ওঠ। ধূমকেতু দেখবি না?
উঁ। বিরক্ত করো না।
সারাদিন বলে রাখলি এখন বিরক্ত? ওঠ
না, না—
ওঠ বলছি।
উঠছি।
ওঠ।
এই, এই উঠলাম—
কি? উঠলি?
এই তো।
আহ! উঠবি না?
উঁ আর একটু
কাজেই আমার আর ওঠা হয় না ধূমকেতুও দেখা হয় না। শুধু আমার না সবার। এভাবে অনেকদিন পার হয়ে গেল। টিপু এসে একদিন বলল, ধূমকেতু আর বেশিদিন দেখা যাবে না। তখন আমাদের সবার টনক নড়ল।
.
রবিন এসে একদিন বলল আজ রাতে সে যেভাবে হোক ঘুম থেকে উঠবে তারপর সবাইকে ডেকে তুলবে। সত্যি সত্যি শেষ রাতে শুনি রবিন ডাকছে।
এই টোপন ওঠ। না হয় দিলাম পানি ঢেলে।
উঁ। আমি নড়েচড়ে আবার ঘুমিয়ে পড়লাম।
ওঠ! ওঠ বলছি। না হয় দিলাম পানি ঢেলে।
বিরক্ত করিস না।
তিন পর্যন্ত গুনবো। তারপর পানি ঢালবো। এক।
আমি শুয়েই থাকলাম।
দুই। আমি পিটপিট করে দেখার চেষ্টা করলাম সত্যি হাতে পানিটানি কিছু আছে কিনা।
তিন বলেই কিছু বোঝার আগে রবিন আমার গায়ে পানি ঢেলে দিল। আমি লাফিয়ে উঠে বসলাম রবিন খালি গ্লাসটা হাতে নিয়ে হি হি করে হাসতে লাগল। আমার এমন রাগ লাগছিল যে বলার নয় কিন্তু ঘুমটা ভেঙেছে ঠিকই। আম্মা পাশে দাঁড়িয়েছিলেন। হাসতে হাসতে বললেন, ঠিক হয়েছে। এভাবেই তোর ঘুম ভাঙাতে হয়।
রবিন বলল, আম্মাও আমাকে এভাবে ঘুম থেকে তুলেছেন। এই দেখেন না, শার্ট ভেজা রবিন তার ভেজা শার্টের কলার দেখাল।
ভেজা শার্ট! বদলে যাও আম্মা আতঙ্কিত স্বরে বললেন- অসুখ করবে তো।
কিছু হবে না। বলে রবিন আমাকে নিয়ে চলল সলিলদের বাসায়। দুটো ডাক দিতেই সলিল চটপট উঠে গেল। তারপর আমরা গেলাম নান্টুর বাসায়। নান্টুর কানে পালক দিয় সুড়সুড়ি দিয়ে রবিন ওকে ডেকে তুলল। ঘুম থেকে উঠে নান্টু রাগে গজ গজ করতে লাগল। আমাদের দল ভারি হয়ে উঠলে হৈ চৈ চেঁচামেচিতে সবাই উঠে পড়ল। আমাদের ছোট ভাইবোন, আব্বা, আম্মা, শিরি আপা, বুলা আপা, শফিক ভাই, বীরু ভাই, বীরু ভাইদের অ্যালসেশিয়ান কুকুর, সলিলদের মোরগ— সবাই জেগে উঠে ভীষণ হৈ চৈ করতে লাগল। মনে হতে লাগল বুঝি আজ ঈদ। সবাই খোলা মাঠে এসে ধূমকেতু দেখতে লাগলাম। নান্টুর টেলিস্কোপটা সবার হাতে হাতে ঘুরতে লাগল আর নান্টু গর্বে এমন ভাব করতে লাগল যেন টেলিস্কোপ নয়, সে একটা আস্ত রকেট বানিয়েছে।
.
ধূমকেতুটা দেখতে যা ভীষণ— সেটা বুঝিয়ে বলা যায় না। ছোট্ট জ্বলজ্বলে একটা মাথা আর প্রকাণ্ড বড় লেজ আকাশটা প্রায় অর্ধেক দখল করে রেখেছে। তবে খুব ঝাপসা, নান্টুর টেলিস্কোপ দিয়ে দেখলে আরো ঝাপসা দেখা যায়। কিছুক্ষণের ভিতর সবার ধূমকেতু দেখা শেষ হয়ে গেল। সবাই ঘুমোতে চলল। কিন্তু চেঁচামেচি হৈ চৈ করে আমাদের এমন অবস্থা হয়েছে যে এখন হাজার চেষ্টা করলেও ঘুম আসবে না। আমরা ঠিক করলাম এখন আর ঘুমাবো না, লুকোচুরি খেলব।
.
আম্মারা বৃথাই খানিকক্ষণ ডাকাডাকি করে গিয়ে শুয়ে পড়লেন— আমরা খুব উৎসাহের সাথে লুকোচুরি খেলতে লাগলাম। খানিকক্ষণ পরেই ভয় ভয় লাগতে লাগল। অন্ধকারে কে কোথায় লুকিয়েছে বোঝা যায় না আর বুকের ভিতর ধুক ধুক করতে থাকে, মনে হয় অন্ধকার থেকে কেউ বুঝি লাফিয়ে ঘাড়ে এসে বসবে।
এর মাঝে হঠাৎ রবিন বলল, চল আমাদের গুপ্তধনটা দেখে আসি।
এতো রাতে?
হ্যাঁ। ক্ষতি কি?
শ্মশানের কাছে! জঙ্গলে! না বাবা আমি যাব না! নান্টু বেঁকে বসল।
যাবি না কেন? আমরা এতগুলো মানুষ।
ব্যাপারটাতে বেশ খানিকটা ভয় আছে। সবাই মিলে যাব তাই ভয়টা গায়ে লাগবে না, অথচ ব্যাপারটা বেশ রোমাঞ্চকর হবে। আমরা রাজি হয়ে গেলাম, নান্টুও বাধ্য হয়ে রাজি হল।
সেই শেষরাতে, অন্ধকারে, নির্জন পথে আমরা দল বেঁধে হাঁটতে লাগলাম। অন্ধকার ছমছমে ভাব, নির্জন রাস্তা, মাঝে মাঝে টিমটিমে লাইট পোস্টের আলো, সব মিলিয়ে এমন হয়ে গেল যে আমরা ধীরে ধীরে চুপচাপ হয়ে গেলাম। কথাবার্তা হতে লাগল ফিসফিস করে, মনে হতে লাগল জোরে কথা বললেই একটা কিছু ঘটে যাবে। হাঁটতে হাঁটতে একসময় একটা গাছের নিচে আসতেই একটা পাখি এমন ঝটপট করতে করতে উড়ে গেল যে আমরা সবাই ভীষণ চমকে উঠলাম।
নদীর তীরে এসে আমাদের গা ছমছম করতে লাগল। এখন শ্মশান পার হয়ে জঙ্গলে ঢোকা সত্যি খুব সাহসের কাজ। সবগুলি ভূতের গল্প আমার একসাথে মনে পড়ে গেল।
ঐ দেখ! ফিসফিস করে বলে সলিল হঠাৎ ছিটকে আমাদের কাছে সরে আসল।