আবার খেলা শুরু হল। এবার উত্তেজনা অনেক বেশি। বল একবার দারুণ ভাবে আমাদের দিকে ছুটে আসছিল আবার দারুণ ভাবে ওদের দিকে ছুটে যাচ্ছিল। একবার আমাদের পাড়ার ছেলেমেয়েরা চেঁচাতে লাগল একবার তাদের ছেলেরা। রবিন আর সলিল মরিয়া হয়ে উঠল। খেলা শেষ হতে আর মাত্র দশ মিনিট বাকি। একবার সুযোগ মত বল পেয়ে রবিন ছুটে চলল। আমার কেন জানি মনে হল এবারে গোল দিয়ে দেবে। আক্কাসকে পাশ কাটিয়ে ওদের ব্যাকের পাশ দিয়ে বল সরিয়ে রবিন সলিলকে পাশ দিল। সলিল আবার ফিরিয়ে দিল তাকে। রবিন বলটাকে থামিয়ে ঘুরে এক লম্বা কিক গোলকীপারের হাত বাচিয়ে সোজা গোল পোস্টে, বুলেটের মত!
আমরা আনন্দে হাত ছুঁড়ে নাচতে লাগলাম। রবিন সবাইকে কানে কানে কি একটা বুদ্ধি শিখিয়ে দিল। খেলা শুরু হলেই বুঝতে পারলাম বুদ্ধিটা কি। লম্বা কিক দিয়ে ওরা বলটাকে মাঠে নাচাতে লাগল। দরকার হলে মাঠের বাইরে। সময়টা কোনমতে কাটাতে পারলেই কেল্লা ফতে! ঠাকুরপাড়ার ছেলেরা রাগে দুয়ো দুয়ো করতে লাগল। উত্তরে আমাদের ছেলেরাও উল্টো দুয়ো দিতে শুরু করল।
সময় প্রায় শেষ হয়ে এসেছে তখন হঠাৎ ওরা একটা মারাত্মক সুযোগ পেয়ে গেল। রশীদ নামের ওদের সবচেয়ে মারাত্মক ছেলেটি ফাঁকা অবস্থায় কিভাবে জানি বলটা পেয়ে গেল। তারপর কোন দিকে না তাকিয়ে সে গোল পোস্টে আমার দিকে ছুটে আসতে লাগল। উত্তেজনায় আমি থরথর করে কেঁপে উঠলাম। রবিন প্রাণপণে ছুটে আসছে পিছু পিছু সবাই। রশীদ তখন একেবারে কাছে এসে পড়েছে কিক করলেই গোল সুনিশ্চিত, নেহায়েত ভাগ্য যদি সাহায্য না করে। হঠাৎ রবিন পিছন থেকে ঝাঁপিয়ে পড়ল, তারপর পুরানো কায়দায় কাটা হাত দিয়ে বলটা ছিটকে সরিয়ে দিল।
হৈ চৈ চেঁচামেচি তার মাঝে রেফারীর বাঁশী বেজে উঠল। পেনাল্টি হয়েছে। রবিন যুক্তি দেখাল ওর হাত নেই হ্যাণ্ডবল হতে পারবে না। রেফারী মানল না ইচ্ছে করে হ্যাণ্ডবল, গোল পোস্টের সীমানার ভিতর, কাজেই এটি পরিষ্কার পেনাল্টি! রেফারীর বিরুদ্ধে তো কথা বলা যায় না রবিন আমার দিকে তাকিয়ে শুকনো গলায় বলল, তোর উপর সব নির্ভর করছে!
উত্তরে আমি ফ্যাকাসে ভাবে হাসলাম! আর মাত্র একটি মিনিট বাকি!
রশীদ পেনাল্টি কিক করবে, সবাই সরে দাঁড়াল। আমি একা গোল পোস্টে। উত্তেজনায় সবাই আমাকে ঘিরে দাঁড়িয়েছে, রেফারী ঠেলে সরাতে পারছে না। ভিড়ের ভিতর থেকে বীরু ভাইয়ের গলার আওয়াজ শোনা গেল, টোপন! গোল বাঁচাতে পারলে, মর্নিং শো!
আমার বুকের ভিতর তখন ঢাকের মত শব্দ হচ্ছে। এতো বড় গোল পোস্ট, তার মাঝে এতো ছোট আমি, তার উপর এতো কাছে থেকে কিক করছে! রেফারী বাঁশী বাজাল। রশীদ একটু হাসল, তারপর ছুটে এসে কিক করল– দারুণ জোরে!
উত্তেজনায় কিছু খেয়াল নেই শুধু দেখছিলাম বলটা গুলির মত ঠিক আমার দিকে ছুটে আসছে। ধাতস্থ হয়ে দেখি বলটা আঁকড়ে ধরে মাটিতে লুটোপুটি খাচ্ছি। হৈ চৈ করতে করতে রবিন সলিল কাসেম ওরা এসে আমায় কাঁধে তুলে নিল। কে জানি চিৎকার করল থ্রী চীয়ার্স ফর টোপন হিপ হিপ হুররে! হিপ হিপ হুররে!!
এর মাঝে রেফারীর বাঁশী বেজে উঠল। খেলা শেষ, আমরা জিতে গেছি। আনন্দে আমার বুকের ভিতর গুরগুর করে উঠে!
০৬. নদীর সাথে পরিচয়
শহরের সেরা ফুটবল টিম নাম হয়ে যাবার পর আমাদের আর ফুটবল খেলতে ভাল লাগে না। আগে আমাদের তবু একটা উদ্দেশ্য ছিল এখন কোন উদ্দেশ্য নেই। কি করব কিছুতেই ঠিক করতে পারছিলাম না ঠিক এই সময়ে আমরা একটা নৌকা পেয়ে গেলাম।
আমাদের সাথে ভর্তি হয়েছিল নতুন একটা ছেলে, নাম টিপু, ভারি সুন্দর দেখতে। ওদের বাসা নদীর তীরে। ছেলেটা আমাদের খুব বন্ধু হয়ে গেল। প্রথমে অবিশ্যি ওর ভাব। হল নান্টুর সাথে। নান্টুর মত টিপুও ভীষণ গল্পের বই পড়ে। বই বদলাবদলি করতে করতে ওদের বন্ধুত্ব হয়েছিল। পরে দেখা গেল নান্টুর সাথে তার অনেক মিল। সেও নান্টুর মত একটা ল্যাবরেটরি তৈরি করতে চায়। নান্টু যেরকম কিছু জোগাড় করতে পারেনি ওর অবিশ্যি সেরকম অবস্থা নয়। বেশ অনেক যন্ত্রপাতি আছে, নিজে নাকি একটা সিনেমা প্রোজেক্টরও বানিয়েছে। ওর সাথে পরিচয় হবার আগে আমরা ভেবেছিলাম ও ভীষণ নাক উঁচু অহঙ্কারী। কিন্তু আমাদের বন্ধু হয়ে যাবার পর দেখলাম ওর স্বভাব ভীষণ ভাল। টিপু এতো ভাল ছেলে যে সবার সাথেই সে বন্ধু হয়ে যায়। ও কখনো রাগ করে না, খারাপ কথা বলে না। ওকে আমরা তুই তুই করে বললেও সে কিন্তু ভুলেও কখনো আমাদের তুই বলে না। ওকে এ সম্বন্ধে কিছু জিজ্ঞেস করলে শুধু হাসে!
একদিন টিপু এসে আমাদের বলল, তোমরা আমাদের বাসায় এসো। আমি একটা নৌকা কিনেছি।
নৌকা? কিনেছিস?
আমি কিনিনি, আব্বা কিনে দিয়েছেন।
কিনে দিয়েছেন? তোকে? আমরা ভারি অবাক হলাম। নৌকা আবার কিনে দেবার জিনিস নাকি? ফুটবল হলে না হয় একটা কথা ছিল, বড় জোর সাইকেল। তাই বলে নৌকা?
আব্বাকে বলেছিলাম। প্রথমে রাজি হননি পরে কিনে দিয়েছেন।
কত বড় নৌকা?
বেশি বড় না। দশ বারজন বসা যায়। আমি খুব ছোট চাইছিলাম, আব্বা বললেন একটু বড় হলে ডোবার ভয় কম থাকে।
ছই আছে? বৈঠা? পাল?
কিছুই নেই শুধু একটা বৈঠা আছে।
আমরা ভারি উৎসাহিত হলাম। স্কুল ছুটি হতেই বাসায় না গিয়ে সবাই টিপুর লাসায় হাজির হলাম। টিপু আমাদের নিয়ে ওদের বসার ঘরে বসাল। কি চমৎকার ঘর! নীল রংয়ের ভারি পর্দা ঘরটাকে আবছা অন্ধকার করে রেখেছে। লাল কার্পেট, ঝকমকে সোফা, দেয়ালে বড় বড় ছবি, শেলফে হাজার হাজার বই, শোকেসে চিনামাটির পুতুল। আমরা বুঝতে পারলাম টিপুর আব্বা খুব বড়লোক।