রত্না কি মানুষটাকে থামাতে পারবে? তাকে শেখানো হয়েছে এ রকম সময়ে কথা বলে যেতে হয়। রত্না কথা বলতে থাকল।
কথা বলতে থাকল।
৬. জুলহাজ কানে টেলিফোনটা ধরে
জুলহাজ কানে টেলিফোনটা ধরে অন্যমনস্কভাবে দাঁড়িয়ে রইল। মেয়েটা কথা বলে যাচ্ছে। কী বলছে জুলহাজ ভালো করে শুনছে না। দূরে কোথায় জানি বিদ্যুৎ চমকাচ্ছে। ঠান্ডা একটা বাতাস হঠাৎ করে তার শরীরটা একটুখানি শিউরে উঠে। নীলা বৃষ্টিকে খুব পছন্দ করতো। হঠাৎ করে মাঝরাতে যদি বৃষ্টি
শুরু হতো সে জুলহাজকে ধাক্কা দিয়ে ডেকে তুলতো, জুলহাজ ঘুম ঘুম গলায় বলতো, “কী হয়েছে।”
নীলা বলতো, “বৃষ্টি হচ্ছে। দেখো দেখো।”
জুলহাজ বলতো, “বৃষ্টির মাঝে দেখার কী আছে?”
নীলা তখন বিছানা থেকে নেমে জানালার পাশে এসে দাঁড়াতো। বাইরে অন্ধকার, মাঝে মাঝে বিদ্যুৎ চমকাচ্ছে। এলোমেলো বাতাসে মাঝে মাঝে বৃষ্টির পানি জানালার দিয়ে ভেতরে আসছে, বৃষ্টির ঝাঁপটা এসে লাগছে নীলার গায়ে কিন্তু নীলা সরে যায় না। জানালার সামনে দাঁড়িয়ে বাইরে তাকিয়ে থাকে। এতে মুগ্ধ হয়ে কী দেখে জুলহাজ বুঝতে পারে না।
মনে আছে একদিন সকালে আকাশ কালো করে মেঘ এসেছে। গুড়গুড় শব্দ করে মেঘ ডাকছে, তারপর বৃষ্টি শুরু হলো। জুলহাজ জানালা দিয়ে বাইরে তাকালো, তারপর ভুরু কুঁচকে বলল, “হায় হায় এতো ওয়েদার খারাপ, আমি অফিস যাব কেমন করে?”
নীলা কেমন জানি রেগে উঠল, বলল, “কী বললে তুমি? ওয়েদার খারাপ? খারাপ? এতো সুন্দর বৃষ্টিকে তুমি খারাপ বলছ?”
জুলহাজ হাসি হাসি মুখে বলল, “বৃষ্টির মাঝে কোন জিনিষটা ভালো?”
নীলা বলল, “এক বোতল পানি তুমি কয় টাকা দিয়ে কিনো?”
আলোচনা কোনদিকে যাবে জুলহাজ অনুমান করতে পারে না, সে সরল মুখে জিজ্ঞেস করল, “পাইকারি না খুচরা?”
“ঢং করবে না-বল কতো দিয়ে কিনো?”
“এই দশ টাকার মতো।”
“তাহলে বল এখন কয় বোতল পানি পড়ছে আকাশ থেকে? বল।”
জুলহাজকে স্বীকার করতে হলো, অনেক বোতল পানি পড়ছে আকাশ থেকে। নীলা বলল, “আকাশ থেকে লক্ষ লক্ষ টাকার পানি পড়ছে। কোটি কোটি টাকার পানি পড়ছে। বুঝেছ?”
জুলহাজ মাথা নেড়ে বলল, “বুঝেছি।”
নীলা মুখে একটা কৃত্রিম কাঠিন্য ধরে রেখে বলল, “খোদা যেহেতু তোমার ভেতরে বৃষ্টির সৌন্দর্য দেখার ক্ষমতা দেয় নাই সেই জন্যে টাকা পয়সার কথা বললাম। অন্তত টাকার হিসাবটা তো বুঝবে!”
জুলহাজ হাসি হাসি মুখে নীলার কথা মেনে নিল। আরেকবার দুইজন রিকশা করে আসছে, হঠাৎ তুমুল বৃষ্টি শুরু হয়ে গেল। দেখতে দেখতে রাস্তা পানিতে ডুবে গেলো। বুড়ো রিকশাওয়ালা ভিজে চুপসে কোনোমতে রিকশাকে টেনে টেনে নিচ্ছে। তখন নীলা বলল, “চল, রিকশা থেকে থেমে যাই। বৃষ্টিতে ভিজি।”
জুলহাজ অবাক হয়ে বলল, “বৃষ্টিতে ভিজবে?”
“হ্যাঁ। সমস্যা কী?”
“সবকিছু ভিজে যাবে যে-”
“ভেজার জন্যই তো ভিজব।”
“ফোন মানিব্যাগ-”
“আমাকে দাও, ব্যাগের ভেতর রাখি।”
জুলহাজ কিছু বোঝার আগে নীলা থেমে গেল। রিকশাওয়ালাকে ভাড়া দিয়ে জুলহাজ নেমে আসে। নীলা পানিতে ছপছপ করে হাঁটতে থাকে। জুলহাজ আর কী করবে? নীলার পিছু পিছু যেতে থাকে। নীলা বৃষ্টিতে ভিজে চুপসে গেল, একটু পরে পরে জুলহাজের দিকে তাকায় আর বলে, “কী মজা হচ্ছে। তাই না?”
জুলহাজ মজাটা কোথায় ধরতে পারল না কিন্তু নীলার কথা শুনে মাথা নাড়লো। বৃষ্টির পানি তার চুল বেয়ে মুখে, মুখ বেয়ে চিবুকে গড়িয়ে যাচ্ছে চোখের আই লাইনার ধুয়ে কালো রং মাখামাখি, কাপড় ভিজে শরীরের সাথে লেপ্টে আছে-এর ভেতরে যদি একজন মজা পায় সেটা দেখেও তো তার মজা হওয়া উচিত। রাস্তার ময়লা পানিতে ছপ ছপ করে নীলা হাঁটতে থাকে, একটু পরে পরে উপরের দিকে তাকায়, বৃষ্টির পানি তার চোখ মুখ বেয়ে গড়িয়ে গড়িয়ে পড়ছে আর নীলা ছোট বাচ্চার মত হি হি করে হাসছে। একজন মানুষ যে শুধু বৃষ্টি আর বৃষ্টির পানি থেকে এতো আনন্দ পেতে পারে জুলহাজ আগে কখনো চিন্তা করেনি।
দূরে মেঘ গুড়গুড় করে গর্জন করে উঠল। জুলহাজ কার্নিশে দাঁড়িয়ে দেওয়ালে হেলান দিয়ে দাঁড়ায়। ঠান্ডা বাতাসটা বইতে শুরু করেছে। জুলহাজ দূরে তাকাল, মনে হয় সত্যি সত্যি নীলার বৃষ্টিটা চলে আসবে? জুলহাজ কি নিচে লাফিয়ে পড়ার আগে একটু অপেক্ষা করবে? বৃষ্টিটা আসতে দেবে?
“বলবেন?” জুলহাজ অন্যমনস্কভাবে ফোনটা ধরে রেখেছিল, ফোনে মেয়েটা কথা বলে যাচ্ছে, একটু পরে পরে জিজ্ঞেস করছে, “বলবেন?” কী বলবে সে? জুলহাজের বিরক্ত হওয়ার কথা, রেগে ওঠার কথা। কিন্তু সে বিরক্ত হয়ে উঠছে না, রেগেও যাচ্ছে না। এই সরল টাইপের কমবয়সী মেয়েটার কথাগুলোকে কেমন করে জানি প্রশ্রয় দিয়ে যাচ্ছে।
জুলহাজ শুনলো মেয়েটা বলছে, “বলবেন? আপনার ওয়াইফ নিয়ে কিছু একটা বলবেন?”
জুলহাজ বলল, “নীলা খুব বৃষ্টি পছন্দ করতো।”
অন্য পাশ থেকে মেয়েটা আনন্দে একটুখানি চিৎকার করে উঠল, বলল, “আমিও খুব বৃষ্টি পছন্দ করি।”
“আমি অবশ্যি জানি না, বৃষ্টিকে এতো পছন্দ করার কী আছে।”
“একটা কিছু পছন্দ করার জন্য আসলে কোনো কারণের দরকার হয় না।”
“সত্যি?”
“হ্যাঁ। কোনো কোনো জিনিস কোনো কারণ ছাড়াই ভালো লেগে যায়।”
“তুমি কেমন করে জান?”
“কারণ-কারণ, আমি, আমার–”