সুজিত বলল, “তুই বেঁচে যাবি কেউ ভাবে নাই। খুবই খারাপ অবস্থা ছিল-”
জুলহাজ এবারে চিৎকার করে উঠল, “নীলা? টুটুল?”
সুজিত অন্যদিকে তাকিয়ে রইল। কোনো কথা বলল না।
জুলহাজের নাকে অক্সিজেনের টিউব, গলায় কেনোলাতে স্যালাইনের টিউব। শরীরের নানা জায়গায় সেন্সর। জুলহাজ টান দিয়ে সব খুলে ফেলে হাহাকার করে উঠল। সুজিত ভয় পেয়ে চিৎকার করে বলল, “সিস্টার! সিস্টার!”
কয়েকজন তার দিকে ছুটে এলো। কয়েকজন তাকে চেপে ধরে রাখে, একজন কোথায় জানি তাকে একটা ইনজেকশান দিল। জুলহাজ থরথর করে কাঁপতে থাকে। থরথর করে কাঁপতে থাকে।
.
ছয়তলা বিল্ডিংয়ের কার্নিশে দাঁড়িয়ে জুলহাজ থরথর করে কাঁপতে থাকে। কানে একটা ফোন ধরে রেখেছে। ফোনে কেউ একজন কথা বলছে। বাচ্চা একটা মেয়ের রিনরিনে গলা। মেয়েটা কিছু একটা বলছে। কী বলছে?
“আপনি কি বলবেন, আপনি কেমন করে আপনার ওয়াইফ আর ছেলেকে খুন করেছেন?”
জুলহাজ কোনো কথা বলল না। তার শরীর কাঁপছে। সে নিজেকে শান্ত করার চেষ্টা করতে থাকে।
“বলবেন? বলবেন আপনি?”
জুলহাজ একটা নিঃশ্বাস ফেলে বলল, “গাড়ী দিয়ে! আমি গাড়ী চালাচ্ছিলাম-”
“গাড়ী? গাড়ী চালাচ্ছিলেন? আপনার ওয়াইফ আর ছেলে গাড়ীতে ছিল?”
“হ্যাঁ।”
“তার মানে তারা গাড়ী একসিডেন্টে মারা গেছে! আপনি আসলে খুন করেননি-আসলে এক্সিডেন্ট-”
“একই কথা।” জুলহাজ শুনল, মেয়েটা একটু হাসির মত শব্দ করল। নার্ভাস হাসি, তারপর বলল, “মোটেও একই কথা না। মার্ডার আর এক্সিডেন্ট একই কথা না-কখনোই এক কথা না।”
মেয়েটার ছেলেমানুষী কথা শুনে জুলহাজের রেগে ওঠার কথা ছিল, জুলহাজ কেন জানি রাগতে পারল না। নরম গলায় বলল, “একই কথা। আমার কারণে দুজনে মারা গেছে। শুধু মাত্র আমার কারণে।”
অন্য পাশে মেয়েটা চুপ করে রইল। তারপর একটা নিঃশ্বাস ফেলল, বলল, “আপনি যদি এভাবে ভাবেন আমার কিছু বলার নেই। আমি আসলে আপনার সাথে তর্ক করতে চাই না।”
“আমার কথা না মানলেও তর্ক করবে না?”
“না।”
“কেন না?”
“কারণ-কারণ, আমার আপনার সাথে তর্ক করার কথা না।”
“কী করার কথা?”
“আপনার কথা শোনার কথা।”
“কী কথা?”
“আপনি যেটা বলতে চান। যা ইচ্ছা-”
“কেন?”
মেয়েটা কিছুক্ষণ চুপ করে রইল। তারপর বলল, “আপনি যদি কথা বলেন তাহলে মনটা একটু হালকা হবে। যখন মনটা হালকা হবে তখন তখন-”
“তখন আমি আমার মাইন্ড চেঞ্জ করব?”
মেয়েটা চুপ করে রইল।
জুলহাজ বলল, “আমার মাইন্ড চেঞ্জ করার কোনো স্কোপ নাই। আমি অনেকদিন প্ল্যান করে আজকের দিনটা ঠিক করেছি।”
মেয়েটা এবারেও চুপ করে রইল।
জুলহাজ বলল, “বেঁচে থাকাটাই সব না। বেঁচে থাকাটা যদি খুব কষ্টের হয় তাহলে শুধু শুধু বেঁচে থাকার কোনো মানে হয় না। বুঝেছ?”
মেয়েটা এবারেও কোনো কথা বলল না।
জুলহাজ আবার জিজ্ঞেস করল, “বুঝেছ?”
“হ্যাঁ বুঝেছি। কিন্তু—”
”কিন্তু কী?”
“একটা কিছু বুঝলেই সেটা মেনে নেয়া যায় না। বোঝা আর মেনে নেয়া আলাদা জিনিস।”
জুলহাজ কিছুক্ষণ চুপ করে রইল। তারপর বলল, “তোমার বয়স কতো বলেছিলে?”
“আঠারো। আঠারো বছরের কম হলে ভলান্টিয়ার হওয়া যায় না।”
“আঠারো বছর বয়সের জন্যে তুমি বেশ গুছিয়ে কথা বল।”
“থ্যাংক ইউ।”।
“ঠিক আছে, পরী। নিচে এখন কোনো গাড়ী নাই-লাফ দেওয়ার জন্যে আইডিয়াল। আমি গেলাম-”
মেয়েটা ব্যস্ত হয়ে বলল, “এক সেকেন্ড, এক সেকেন্ড, এক সেকেন্ড-”
“কী হল?”
“আপনার কি ভয় করছে?”
“না। ভয় করছে না।”
“দুঃখ লাগছে?”
“মরে যাব সেই জন্যে দুঃখ?”
“হ্যাঁ।”
“না, দুঃখ লাগছে না। আমার কিছুই লাগছে নাড়”
“সুইসাইড করার আগে শেষবার কিছু একটা করার ইচ্ছা করছে?”
“না করছে না।”
“আপনার কী করতে ভালো লাগতো?”
জুলহাজ কিছুক্ষণ চুপ করে রইল। তারপর জিজ্ঞেস করল, “তোমার নাম কী বলেছিলে, পরী?”
“হ্যাঁ, পরী।”
“পরী, তুমি খামোখা সময় নষ্ট করছ। শুধু শুধু আজে বাজে কথা বলে আমার সময় নষ্ট করছ। তাই না।”
পরী নামের মেয়েটা চুপ করে রইল।
”আমি ঠিক বলেছি কিনা?”
“হ্যাঁ। ঠিক বলেছেন।”
“শুধু শুধু সময় নষ্ট করে লাভ নাই। বুঝেছ? আমি একজন বড় মানুষ। ম্যাচিওর্ড মানুষ। তুমি একটা বাচ্চা মেয়ে। আমার টুটুল থেকে তুমি খুব বেশী বড় না। বুঝেছ পরী?”
“আমার পরী নামটা আপনার কেমন লাগে?”
জুলহাজ একটু থতমত খেয়ে গেল। বলল, “কী বললে?”
আমি জিজ্ঞেস করেছি, “আমার পরী নামটা আপনার কেমন লাগে?”
“তুমি কেন এসব জিজ্ঞেস করছ? শুধু কথা বাড়ানোর চেষ্টা করছ?”
পরী নামের মেয়েটা বলল, “না, এটা কথা বাড়ানোর জন্যে জিজ্ঞেস করছি না। এটা সত্যি সত্যি জানতে চাইছি।”
“সত্যি কথা বলব?”
“বলেন।”
“নামটা ক্লিশে।”
“ক্লিশে?”
“হ্যাঁ।”
“ক্লিশে মানে কী?”
“অতি ব্যবহারে জীর্ণ।”
“কী আশ্চর্য!”
“কোন জিনিসটা আশ্চর্য?”
“এই যে অতি ব্যবহারে জীর্ণ এর জন্যে একটা শব্দ আছে।”
“যাই হোক তুমি আমার কথা শুনে মনে দুঃখ পেয়েছ?”
“না। বেশী দুঃখ পাই নাই। আপনি যে এ রকম একটা অবস্থায় আমার কথার উত্তর দিয়েছেন সেই জন্যে আপনাকে থ্যাংক ইউ।
“ইউ আর ওয়েলকাম। তাছাড়া তোমার নামটা ক্লিশে সেটা তো তোমার দোষ হতে পারে না। তোমার নাম তো তুমি রাখো নাই।”
“আসলে এই নামটা আমিই রেখেছি।”
জুলহাজ ভুরু কুঁচকালো, “তুমি রেখেছ?”
“হ্যাঁ। এইটা আমার আসল নাম না। এইটা বানানো নাম। আমরা আসল নাম বলি না। একটা বানানো নাম বলি।”