“কেন? কার্নিশে?”
“কার্নিশে?”
“হ্যাঁ।”
“আপনি কি কার্নিশ থেকে একটু সরে আসবেন?”
“কেন?”
“এমনিই। এমনিই-কার্নিশে দাঁড়িয়ে আছে একজন আমার চিন্তা করতেই কেমন জানি গা শিরশির করছে। সেই জন্যে। আর কিছু না।”
“আমি কার্নিশে থাকি না কোথায় থাকি তাতে তোমার কী?”
“না আমার কিছু না। কিন্তু মানে তবু-”
“তবু কী?”
“না, কিছু না। কিছু না।”
“তুমি কী নিয়ে কথা বলতে চাও।”
“যে কোনো কিছু নিয়ে। আপনার যেটা ইচ্ছা।”
“আমার কোনো ইচ্ছা নাই।”
“ঠিক আছে তাহলে আমি বলি?”
“বল।”
রত্না বুক ভরে একটা নিঃশ্বাস নিল। তারপর সাহস করে জিজ্ঞেস করল, “আপনি বলবেন কেন এতো বড় একটা ডিসিশন নিলেন?”
টেলিফোনের অন্য পাশ থেকে মানুষটা মেঘ স্বরে বলল, “তুমি সেটাই জানতে চাও?”
“আপনি যদি বলতে চান তাহলে। বলতে না চাইলে বলতে হবে না। আপনার ইচ্ছা।”
“আমি বলতে চাই না।”
রত্না তাড়াহুড়ো করে বলল, “তাহলে বলতে হবে না। আপনাকে বলতে হবে না। অন্য কিছু বলি। অন্য কিছু।”
“তুমি আসলেই শুনতে চাও? শুনতে চাও মেয়ে?”
“পরী। আমার নাম পরী।”
“শুনতে চাও পরী?” মানুষটা ভারী গলায় বলল, “শুনতে চাও তুমি?”
“হ্যাঁ। শুনতে চাই।”
“আমি সুইসাইড করতে চাই, কারণ-”, মানুষটা থেমে গেল।”কারণ?”
“কারণ আমি আমার স্ত্রী আর ছেলেকে খুন করেছি। খুন মানে জান?”
রত্না ঢোক গিলল। ইতস্তত করে বলল, “হ্যাঁ, মানে ইয়ে-”
মানুষটা আবার হিংস্র একটা শব্দ করল। বলল, “খুন।”
৪. জুলহাজের মাথাটা দপ দপ করতে থাকে
জুলহাজের মাথাটা দপ দপ করতে থাকে। হঠাৎ করে তার পুরো দৃশ্যটা মনে পড়ে যায়। গাড়ীটার স্টিয়ারিং ডান হাতে, বাম হাতটা পাশের সীটে। সেখানে নীলা বসে আছে। জানালা খোলা। বাতাসে নীলার চুল উড়ছে। ড্যাশ বোর্ডে একটা গান বাজছে। প্রেমের গান। জুলহাজ আঙুল দিয়ে টোকা দিয়ে তাল দিচ্ছে। গাড়ী চালাতে চালাতে সে মাথা ঘুরিয়ে পিছনে তাকালো টুটুল গভীর মনোযোগ দিয়ে তার ছবির বইটা দেখছে। ছেলেটা তার মায়ের মত শান্ত হয়েছে। কোনো কিছু নিয়ে বিরক্ত করে না। হাতে একটা বই ধরিয়ে দিলে গভীর মনোযোগ দিয়ে ছবিগুলো দেখতে থাকে। ছবি দেখতে দেখতে কী যেন ভাবে। এইটুকু মানুষ যখন মুখ গম্ভীর করে কিছু একটা ভাবে সেই দৃশ্যটা দেখে জুলহাজের হাসি পেয়ে যায়।
জুলহাজ স্টিয়ারিংয়ে হাত রেখে বাইরে তাকালো। দুইপাশে ধানক্ষেত। আর কিছুক্ষণ গেলেই চা বাগানে ঢুকে যাবে। চা বাগানের ভেতর দিয়ে আঁকাবাঁকা রাস্তা, দেখতে খুব ভালো লাগে। রঙিন শাড়ী পরে। চা শ্রমিকেরা মাথায় বড় বড় ঝাঁকাতে করে চা পাতা নিয়ে হাঁটছে। রাস্তাটা নিরিবিলি এখানে হাইওয়ের মতো বড় বড় বাস ট্রাক নেই।
নীলা কিছু একটা বলল, জুলহাজ ঠিক শুনতে পেলো না, একটা ছোট গাড়ীকে পাশ কাটিয়ে সামনে গিয়ে জিজ্ঞেস করল, “কী বলছ নীলা?”
নীলা আবার বলল, আর ঠিক তখন দৈত্যের মত বিশাল একটা বাস তাকে পাশ কাটিয়ে যাওয়ার সময় তার গাড়ীটাকে ধাক্কা দিল। জুলহাজের ছোট গাড়ীটা কেমন যেন বাতাসে উড়ে গেলো। গাড়ীটা শূন্যে পাক খাচ্ছে, একবার, দুইবার, তিনবার। রাস্তা থেকে উড়ে গিয়ে নিচে পড়েছে মুহূর্তের মাঝে সবকিছু ওলট পালট হয়ে গেলো। প্রচণ্ড একটা আঘাত, সবকিছু ভেঙেচুরে যাওয়ার শব্দ তারপর হঠাৎ চারিদিক নিঃশব্দ হয়ে গেলো, শুধু ড্যাশবোর্ডের সিডি প্লেয়ারে প্রেমের গানটি বেজে যাচ্ছে, এক বৈশাখে দেখা হলো দুজনে জষ্ঠিতে হলো পরিচয়…।
জুলহাজ মাথা ঘুরিয়ে নীলাকে দেখার চেষ্টা করল, পারল না। পেছনে টুটুলকে দেখতে চাইলো কিন্তু কিছু বোঝার আগেই সবকিছু অন্ধকার হয়ে গেল।
আবছা আবছা ভাবে কখনো কখনো জ্ঞান এসেছে কখনো আবার
অচেতন হয়ে গেছে। মাঝে মাঝে যখন জ্ঞান এসেছে তখন বুঝতে পেরেছে সে হাসপাতালে, তাকে ঘিরে ডাক্তার, নার্স আর মানুষ। প্রচণ্ড তৃষ্ণায় তার বুক ফেটে যাচ্ছে, সে বলতে চাইছে ”পানি! পানি! একটু পানি।” কিন্তু সে বলতে পারছে না। যখনই একটু নড়ার চেষ্টা করেছে তখনই প্রচণ্ড যন্ত্রণায় সে থরথর করে উঠেছে। সে কিছু মনে করতে পারে না, তার কী হয়েছে সে জানে না একদিন সে শুনল কেউ একজন তাকে ডাকছে, “জুলহাজ! এই জুলহাজ! চোখ খুলবি? তাকাবি একবার?” জুলহাজ চোখ খুললো। তাকালো, তার মুখের উপর সুজিত ঝুঁকে আছে। সুজিতের মুখে খোঁচা খোঁচা দাড়ি। তাকে ঝাঁপসা ঝাঁপসা দেখা যাচ্ছে।
জুলহাজ জিজ্ঞেস করল, “আমি কোথায়? কী হয়েছে আমার?”
“এক্সিডেন্ট হয়েছে। তুই, তুই হাসপাতালে-”
সুজিতের কথা শুনে হঠাৎ করে জুলহাজের সব কথা মনে পড়ে গেলো। জুলহাজ গাড়ী নিয়ে যাচ্ছিল, তার পাশে বসে ছিল নীলা। পিছনে ছিল টুটুল। টুটুলের হাতে ছিল ছবির একটা বই। ড্যাশবোর্ড থেকে গানের সুর ভেসে আসছিল, ‘এক বৈশাখে দেখা হলো দুজনার’-জুলহাজ তখন বিদ্যুৎস্পৃষ্ঠের মত চমকে উঠল, নীলা আর টুটুল কেমন আছে?
জুলহাজ ধড়মড় করে উঠে বসার চেষ্টা করল, কিন্তু পারল না। শুয়ে থেকে প্রায় চিৎকার করে জিজ্ঞেস করল, “নীলা আর টুটুল? নীলা আর টুটুল কেমন আছে? নীলা”
সুজিত তার দৃষ্টি এড়িয়ে ফিস ফিস করে বলল, “তুই অনেক বড় বিপদ থেকে বেঁচে এসেছিস। ডাক্তাররা তোর আশা ছেড়ে দিয়েছিল।“
জুলহাজ অধৈর্য হয়ে জিজ্ঞেস করল, “নীলা? টুটুল?”