টেলিফোনটা রেখে তিষা নামের মেয়েটা অন্য সবার দিকে তাকিয়ে ফোঁস করে একটা লম্বা শ্বাস ফেলল, তারপর বলল, “আমাদের দেশের মেয়েগুলো হচ্ছে বোকা আর ছেলেগুলো হচ্ছে বদমাইস।”
রংচংয়ে ম্যাগাজিন হাতে দাঁড়িয়ে থাকা ছেলেটা বলল, “তিষা, তুই মনে হয় এখনো জানিস না যে আমি একজন ছেলে!”
“তুই ছেলে হয়েছিস তো কী হয়েছে? আমি সত্যি কথা বলতে পারব না?” মেয়েটা মোটামুটি হিংস্র মুখে বলল, “শুরু হবে ফেসবুক দিয়ে, তারপর টেলিফোন, তারপর দুই চার দিন ফাস্টফুডের দোকান-তারপর স্ট্রেট সেক্স! সেক্স হবার পর ছেলেটা ডাম্প করে চলে যাবে।”
দাঁড়িয়ে থাকা অন্য ছেলেটা রত্নাকে দেখিয়ে বলল, “তিষা, এইখানে বাচ্চা একটা মেয়ে আছে।”
তিষা ঝাঁঝিয়ে উঠল, “খবরদার বাচ্চা বাচ্চা করবি না। এইখানে ভলান্টিয়ার হতে হলে অনেক কিছু পার হতে হয়, এখানে কেউ বাচ্চা না টেলিফোন রিসিভ করবে আর দুনিয়ার ফ্যাক্টস জানবে না এইটা তো হতে পারে না।”
তিষা নামের মেয়েটা এবারে রত্নার দিকে তাকিয়ে বলল, “আপু, আমার নাম তিষা। তুমি-”
“রত্না।”
“রত্না। গুড, তুমি এতো ছোট থাকতেই ভলান্টিয়ার হতে পেরেছ হাউ নাইস। কগ্রাচুলেশন্স!”
রত্না বলল, “হ্যাঁ, কিন্তু পারব কি না সেইটা তো বুঝতে পারছি না।”পারবে না কেন? খুব ভালো পারবে।”
“আমি শুনছিলাম তিষা আপু, তুমি কী সুন্দর করে কথা বলছিলে।”
“তুমিও বলবে। তুমি আমার থেকে সুন্দর করে কথা বলবে।”
রংচংয়ে ম্যাগাজিন হাতে রাজু নামের ছেলেটা বলল, “তিষা শুধু টেলিফোনে সুন্দর করে কথা বলে। সামনা সামনি তার কথাবার্তা খুবই খারাপ।”
তিষা রাজুর কথাটার কোনো গুরুত্ব দিল না, উঠে দাঁড়িয়ে বলল, “পরের শিফটের সবাই এসেছে? আমার যেতে হবে।”
“তুই যা। অন্যরা না আসা পর্যন্ত আমরা আছি।”
তিষা রত্নার দিকে তাকিলে বলল, “ওকে রত্না। তোমার সাথে দেখা হবে। প্রথম শিফটটাই নাইট শিফট দিয়ে শুরু করেছ দ্যাট ইজ গুড। রাত যতো গম্ভীর হয় তত বেশী ইন্টারেস্টিং ফোন আসে। দেখবে কতো এক্সাইটিং।”
তিষা ডেস্কের নিচ থেকে তার ব্যাগটা বের করে কাঁধে ঝুলিয়ে নিয়ে কল সেন্টার থেকে বের হয়ে গেল।
ঠিক তখন রত্নার টেলিফোনটা বেজে উঠল।
রত্না একটু চমকে উঠল, তারপর মাথা ঘুরিয়ে সবার দিকে তাকালো। সবাই হাসি হাসি মুখে রত্নার দিকে তাকিয়ে আছে। ছোট ছোট করে কাটা চুলের রুনু নামের মেয়েটা বলল, “ধরো রত্না।”
রত্না টেলিফোনটা ধরে কল রিসিভ করার বাটনে চাপ দিয়ে কানে লাগালো তারপর শান্ত গলায় বলল, “সুইসাইড হটলাইন থেকে বলছি। আপনাকে আমি কীভাবে সাহায্য করতে পারি?”
অন্য পাশ থেকে কোনো উত্তর নেই। রত্না আবার বলল, “সুইসাইড হটলাইন থেকে বলছি। আমি কি আপনাকে কোনোভাবে সাহায্য করতে পারি?”
এবারেও কোনো উত্তর নেই। রত্না টেলিফোনটা কানে ধরে রেখে একটু অবাক হয়ে অন্যদের দিকে তাকালো। অন্যরা হাসি হাসি মুখে তার দিকে তাকিয়ে আছে। সবাই জানে মাঝে মাঝেই টেলিফোন আসে যখন অন্যপাশে যে থাকে সে কোনো কথা বলে না। মিনিট খানেক চেষ্টা করেও যদি কোনো কথা বলানো না যায় তাহলে টেলিফোনটা কেটে দিতে হয়।
রত্না তা-ই করবে। সে আরো একটু চেষ্টা করবে তারপর লাইন কেটে দেবে। রত্না আবার বলল, “হ্যালো! আমি সুইসাইড হটলাইন থেকে বলছি। আপনি কি আমার কথা শুনতে পাচ্ছেন?” কোনো জবাব নেই, রত্না বলল, “আমার কথা কি শুনতে পাচ্ছেন? আমি কি আপনাকে কোনোভাবে সাহায্য করতে পারি?”
রত্না এবারে স্পষ্ট একটি নিঃশ্বাসের শব্দ শুনতে পেলো। গভীর একটি নিঃশ্বাস। অন্য পাশে যে আছে সে তার কথা শুনছে কিন্তু তার কথার
উত্তর দিচ্ছে না। যদি উত্তর না দেয় তার আর কিছু করার নেই। রত্নাকে যেভাবে শেখানো হয়েছে সে সেভাবে চেষ্টা করল, বলল, “আপনি আমাদের ফোন করেছেন সেজন্যে আমি খুব খুশী হয়েছি। আপনি যদি একটুখানি বলতেন কীভাবে আপনাকে সাহায্য করতে পারি তাহলে আরো খুশী হতাম। বলবেন?”
কোনো উত্তর নেই।
“আপনি কি কথা বলবেন?”
কথা বলল না।
কথা বলার এক পর্যায়ে তাদের জানতে হয় সে মানুষটি কি আত্মহত্যা প্রবণ কিনা। সরাসরি জিজ্ঞেস করে ফেলতে হয়। যে মানুষটি কথাই বলছে
তাকে কি এটা জিজ্ঞেস করা যায়? রত্না কী করবে বুঝতে না পেরে শেষ পর্যন্ত জিজ্ঞেস করেই ফেলল, “কিছু মনে করবেন না প্লীজ, আপনি কি আপনি কি আত্মহত্যা করার কথা ভাবছেন?” অন্য পাশ থেকে কেউ কিছু বলবে রত্না আশা করেনি, কিন্তু সে প্রথমবার একটা কণ্ঠস্বর শুনতে পেলো, কেউ একজন ভারী গলায় ধীরে ধীরে বলল, “হ্যাঁ। আমি ছাদের কার্নিশে দাঁড়িয়ে আছি। লাফ দিব। এক্ষুনি লাফ দিব। ছয়তলা থেকে।”
২. জুলহাজ আবছা অন্ধকারে
জুলহাজ আবছা অন্ধকারে তার বিল্ডিংয়ের ছয়তলার কার্নিশে দাঁড়িয়ে আছে। সে ঠিক যখন নিচে লাফ দেবে তখন সেখানে একটা গাড়ী এসে থেমেছে। গাড়ী থেকে যাত্রীরা নামছে। ছোট একটা ছটফটে শিশু ছোটাছুটি করছে। জুলহাজ তাই কার্নিশে দাঁড়িয়ে রইল। গাড়ীটা সরে যাওয়ার জন্য অপেক্ষা করতে থাকল।
ঠিক তখন তার পকেটের টেলিফোনটা বেজে উঠল। কী আশ্চর্য? এ রকম সময়ে তার পকেটে টেলিফোনটা রয়ে গেছে? বেজে বেজে টেলিফোনটা এক সময় থেমে যাবে মনে করে জুলহাজ নিঃশব্দে দাঁড়িয়ে রইল। টেলিফোনটা সত্যি একসময় থেমে গেল, কিন্তু থেমে গিয়ে আবার সেটা বাজতে শুরু করল। জুলহাজ তখন টেলিফোনটা বের করে সেটাকে চাপ দিয়ে নিঃশব্দ করে দেয়। অচেনা নম্বর অচেনা মানুষ কেন তাকে বিরক্ত করছে? নিচে গাড়ীটা দাঁড়িয়ে আছে তা না হলে সে মোবাইল টেলিফোনটা টুক করে নিচে ফেলে দিতো।