“সবারই একসময় প্রথম ছিল। এটা কোনো ব্যাপার না।”
রত্না মাথা নাড়ল, বলল, “ঠিক আছে আপু।”
সুমী আপু কল সেন্টারের হাতল ঘুরিয়ে দরজাটা খুলে ভেতরে মাথা ঢুকিয়ে উঁকি দিল। রত্না ফিসফিস করে বলল, “এখনো নয়টা বাজে নাই। আমি ঢুকব?”
সুমী আপু নিচু গলায় বলল, “ঢুকবে না কেন? তুমি আমাদের সার্টিফাইড ভলান্টিয়ার যখন খুশী ঢুকতে পারবে। আস। তোমাকে বসিয়ে দেই।”
রত্না সুমীর পিছু পিছু ভেতরে ঢুকলো। পাশাপাশি ছয়টা চৌকোনা ডেস্ক। একটা ডেস্কে একজন মেয়ে টেলিফোনে কথা বলছে। তার পাশের একজন ছেলে ডেস্কের উপর পা তুলে দিয়ে গভীর মনোযোগ দিয়ে একটা রংচংয়ে ম্যাগাজিন পড়ছে। ঘরের মাঝামাঝি দুটি ছেলে এবং মেয়ে নিচু গলায় কথা বলতে বলতে হাসাহাসি করছে। মেয়েটার চুল ছেলেদের মত ছোট করে কাটা। সুমী আপুকে ঢুকতে দেখে ডেস্কের উপর পা তুলে রাখা ছেলেটি তার পা নামিয়ে হাসার ভঙ্গি করল। ঘরের মাঝামাঝি দাঁড়িয়ে থাকা দুইজন ছেলে মেয়ে কথা থামিয়ে সুমী আপুর দিকে তাকিয়ে হাত নাড়ল।
সুমী একটু এগিয়ে গলা নামিয়ে জিজ্ঞেস করল, “কী অবস্থা? কী রকম টেলিফোন আসছে?”
“কম। খুবই কম।”
“গুড। কল কম আসা মানে গুড নিউজ। মানুষের মনে দুঃখ কষ্ট নাই, ডিপ্রেশান নাই। সুইসাইডাল টেন্ডেন্সি নাই।”
দাঁড়িয়ে থাকা চুল ছোট করে কাটা মেয়েটা বলল, “কিংবা মোবাইলে ব্যালেন্স নাই।”
সবাই চাপা স্বরে হাসল। সুমী আপু বলল, “ঠিকই বলেছিস। মনে কষ্ট আছে কিন্তু মোবাইলে ব্যালেন্স নাই।”
রত্না একটু পিছনে খানিকটা বিব্রত ভঙ্গিতে দাঁড়িয়ে ছিল। সুমী আপু তার হাত ধরে টেনে সামনে নিয়ে এসে জিজ্ঞেস করল, “তোদের রত্নার সাথে পরিচয় হয়েছে? আমাদের লাস্ট ব্যাচের ভলান্টিয়ার।”।
দাঁড়িয়ে থাকা ছেলেটা বলল, “ইয়া মাবুদ। এ কি আমাদের ভলান্টিয়ার? আমি ভেবেছিলাম সুইসাইড হটলাইনের ভলান্টিয়ার হতে হলে এডাল্ট হতে হয়। এ-তত দশ বছরের মেয়ে!”
রত্না হাসার চেষ্টা করে বলল, “আমার বয়স আঠারো।”
মেয়েটি বলল, “খোদার কসম! দেখে মনে হয় তোমার বয়স দশ। ম্যাক্সিমাম বারো। ক্লাস সেভেনে পড়।”
“আমি ইন্টার পরীক্ষা দিয়েছি।”
সুমী আপু চুল ছোট মেয়েটিকে দেখিয়ে বলল, “এর নাম রুনু। ইউনিভার্সিটিতে পড়ে।” তার সাথের ছেলেটিকে দেখিয়ে বলল, “এ হচ্ছে ইমরান। সফটওয়ার কোম্পানীতে চাকরী করে।” রংচংয়ের ম্যাগাজিন হাতের ছেলেটিকে দেখিয়ে বলল, “এই হচ্ছে রাজু। আর্কিটেক্ট। আর ঐ যে টেলিফোনে কথা বলছে সে হচ্ছে তিষা।” তারপর রত্নাকে দেখিয়ে বলল, “রত্না আমাদের নতুন ভলান্টিয়ার, কিন্তু রত্না আজকে নাইট শিফট করবে!”
রংচংয়ে ম্যাগাজিন হাতে বসে থাকা ছেলেটা তার চেয়ার থেকে উঠে এগিয়ে এলো, বলল, “ওয়েলকাম রত্না। ওয়েলকাম টু আওয়ার ক্লাব।”
রত্না দুর্বল ভাবে হাসার ভঙ্গি করে বলল, “খুব নার্ভাস লাগছে!”
ম্যাগাজিন হাতে ছেলেটা বলল, “নার্ভাস লাগার কিছু নাই। নাইন্টি পার্সেন্ট কল রুটিন। মা বকা দিয়েছে, বাবা বকা দিয়েছে। জিপিএ ফাইভ হয় নাই। ব্রেক আপ হয়ে গেছে। বয় ফ্রেন্ড পালিয়ে গেছে এইসব। খালি ধৈর্য্য ধরে ওদের কথা শুনবে।”
“বাকী টেন পার্সেন্ট?”
“বাকী টেন পার্সেন্ট একটু সিরিয়াস। কেস টু কেস ডিল করতে হবে।”
রত্না বলল, “ঐ টাই তো ভয়! যদি সিরিয়াস কেস চলে আসে?”
“ভয় নাই। আসবে না। সিরিয়াস কেস কম আসে।”
“ঐ যে আমাদের ট্রেনিংয়ের সময় আপু বলেছিল একটা কেস, বত্রিশটা ঘুমের টেবলেট হাতে নিয়ে ফোন করেছে–যদি সেইরকম কেস আসে?”
“আসবে না। ঐ রকম কেস খুব কম আসে। আমি দুই বছর থেকে কাজ করছি। এখনও পাই নাই।”
সুমী আপু বলল, “যাই হোক আজকে রত্নার প্রথম দিন। তাকে একটা ভালো ডেস্কে বসিয়ে দে।”
রুনু নামের মেয়েটা মাঝামাঝি ডেস্কটা দেখিয়ে দিয়ে বলল, “এইখানে বসে যাও। মোবাইলটা ভালো। কথা পরিষ্কার শোনা যায়।”
রত্না এগিয়ে গেল। ব্যাগটা টেবিলের নিচে রেখে চেয়ারটা টেনে বসল। সস্তা চেয়ার কিন্তু বসে আরাম আছে। টেবিলে একটা ক্লীপ বোর্ড, একটা বল পয়েন্ট কলম। সামনের দেওয়ালে একটা কাগজে তাদের প্রটোকল লেখা। কেউ যদি ভুলে যায় তাহলে কোন প্রশ্নের পর কোন প্রশ্ন
করতে হবে সেগুলো
গুছিয়ে বলে দেয়া আছে।
সুমী বলল, “রত্না তাহলে তুমি শুরু করে দাও। যদি খিদে লাগে ফ্রীজে টুকটাক খাবার আছে। ড্রিংকস। চীপস। রাত তিনটার সময় শিফট বদল হবে। যতক্ষণ পরের শিফট না আসে ম্যানেজ করো!”
“করব।”
সুমী সবার দিকে তাকিয়ে বলল, “তোরা রত্নাকে দেখে শুনে রাখিস।”
সবাই প্রায় এক সাথে বলল, “রাখব।”
রত্না চারিদিকে তাকালো। তিষা নামের যে মেয়েটি টেলিফোনে কথা বলছিল তার কথা আবছা আবছা ভাবে শোনা যাচ্ছে। মেয়েটা খুব সুন্দর করে কথা বলছে। রত্না শোনার চেষ্টা করল, শুনল তিষা বলছে”মাহরীন আপু, তোমার সাথে কথা বলে খুব ভালো লাগলো। থ্যাংক ইউ আপু যে তুমি আমাদের ফোন করেছ। তুমি ঠিকই বলেছ, জিশানের কাজটা ঠিক হয় নাই। কিন্তু তুমি যেভাবে পুরো ব্যাপারটা ফেস করেছ সেটা অসাধারণ।
সিমপ্লি গ্রেট। আজকে তাহলে আমরা এইখানে শেষ করে দিই?” মেয়েটা কিছুক্ষণ অন্য পাশের মাহরীন আপুর কথা শুনল, তারপর বলল, “হা হা মাহরীন আপু। তোমার যখন ইচ্ছা ফোন করতে পার। আমাদের ভলান্টিয়াররা কেউ না কেউ আছে। তারপর বেশ সুরেলা গলায় বিদায় জানাল, “বাই।”