রত্না চুপ করে রইল।
মানুষটা বলল, “ছেলেটা মনে হয় জানতে সে মাত্র পাঁচ বছর তিন মাস সতেরো দিন বেঁচে থাকবে। সেই জন্যে সে অবাক হয়ে সবকিছু দেখতো, কাউকে কিছু জ্বালাতন করতো না। ঢাকা শহরে চাঁদ থাকলেও দেখা যায় না। দেখা গেলেও কেমন জানি লাগে। একবার শ্রীমঙ্গল গিয়েছি। একটা চা বাগানে। রাত্রে এতো বড় একটা পূর্ণিমার চাঁদ উঠেছে-একেবারে ঝক ঝক করছে। টুটুল অবাক হয়ে তাকিয়ে রইল।“ একটু পরে পরে হাত দিয়ে দেখায় আর বলে, “চাঁদ। দেখো চাঁদ।”
রত্না এবারেও চুপ করে রইল। প্রটোকল অনুযায়ী প্রত্যেকটা কথার সাথে তার কিছু একটা বলার কথা যেন মানুষটা জানে সে তার কথা
শুনছে। রত্না আর প্রটোকল মানছে না, মানুষটা যখন তাকে কিছু জিজ্ঞেস
করবে তখন সে উত্তর দেবে। একটা বাবা যখন তার সন্তানের কথা বলছে
তখন মাঝে মাঝে কথা বলার কিছু নেই। সে শুনছে।
মানুষটা হঠাৎ ভাঙা গলায় বলল, “আমার টুটুল চলে যাবার পর আমি কী করতাম জানো?”
“কী করতেন?”
“তার একটা শার্ট মুখের মাঝে চেপে রাখতাম তার শরীরের ঘ্রাণের জন্য। একটু ঘ্রাণের জন্য। তার কিছু পৃথিবীতে নাই, শুধু তার শরীরের একটুখানি ঘ্রাণ রয়ে গেছে। একটুখানি ঘ্রাণ-” মানুষটা আবার হাউমাউ করে কাঁদতে থাকে। আর কী আশ্চর্য রত্নাও ঝরঝর করে কেঁদে ফেলল। রত্না নিজেকে কয়েকবার শান্ত করার চেষ্টা করে ভাঙা গলায় বলল, “আমি বোকার মত কেঁদে ফেলেছি। আমি সরি। আমি রিয়েলি সরি।”
মানুষটা কিছু বলল না। রত্না বলল, “হটলাইনে কথা বলার সময় যদি কেউ কেঁদে ফেলে তাহলে সে ভলান্টিয়ার হতে পারে না। আমি আর ভলান্টিয়ার হতে পারব না।”
“কেন?”
“আমি আর হতেও চাই না। আমি আসলে হতেও পারব না। আমি বোকা। দুর্বল।”
মানুষটি বলল, “না পরী। তুমি বোকা না। দুর্বল না। তুমি অনেক ভালো ভলান্টিয়ার।”
“আপনি আমাকে খুশী করার জন্যে বলেছেন।” রত্না ভাঙা গলায় একটু হেসে ফেলল, “আমার আপনাকে সাহায্য করার কথা। এখন উল্টোটা হচ্ছে। আপনি আমাকে সাহায্য করছেন। থ্যাংক ইউ।”
“তুমি যথেষ্ট ভালো ভলান্টিয়ার।”।
“আসলে আজকে আমার প্রথম দিন। আমি আসলে খুব নার্ভাস ছিলাম। ভয় পাচ্ছিলাম কার সাথে কথা বলতে হবে–সবাই সাহস দিয়েছে
বলেছে কোনো ভয় নাই। বেশীর ভাগ কেস হচ্ছে মায়ের বকা খেয়েছে, বয়ফ্রেন্ড চলে গেছে এ রকম। একবারও ভাবি নাই আপনার সাথে কথা বলতে হবে। আপনাকে সাহায্য তো করতেই পারি নাই উল্টো মনে কষ্ট দিয়েছি। আমি সরি–”
মানুষটা একটা নিঃশ্বাস ফেলে বলল, “না পরী।”
“আমার আসল নাম রত্না।”
“তোমার না আসল নাম বলার নিয়ম নাই।”
“নিয়ম না থাকলে নাই। আমি আর নিয়ম মানছি না। মানার দরকার নাই।”
“কেন?”
“কারণ আপনার সাথে কথা শেষ করে আমি এখান থেকে বের হয়ে চলে যাব। আর কোনোদিন আসব না–আমি আর ভলান্টিয়ার হব না। কোনও দিনও না।”
“কেন হবে না? তুমি যথেষ্ট ভালো ভলান্টিয়ার।”
“না। আমি ভালো ভলান্টিয়ার না। ভালো ভলান্টিয়ার কাউকে কষ্ট দেয় না। ভালো ভলান্টিয়ার নিজে কেঁদে ফেলে না।”
মানুষটা একটা নিঃশ্বাস ফেলল, তারপর এক ধরনের ক্লান্ত গলায় বলল, “তুমি আসলে আমাকে কষ্ট দাওনি। এইটা আমার ভেতরেই ছিল, আমি শুধু চাপা দিয়ে রেখেছিলাম।” মানুষটা একটু থামল, তারপর বলল, “সেটা মনে হয় আরো বেশী কষ্ট।”
“আমি আপনাকে জোর করে আটকে রেখেছিলাম, জোর করে কথা বলানোর চেষ্টা করছিলাম। আর করব না। আপনি যখন ইচ্ছা কথা বলা বন্ধ করে দিবেন। যখন ইচ্ছা-”
“আসলে টেলিফোনে চার্জ নাই। তার উপর বৃষ্টিতে ভিজে আছে। যে কোনো সময় লাইন কেটে যাবে। যদি লাইন কেটে যায় তাহলে রত্না তোমাকে থ্যাংক ইউ।”
“আমাকে থ্যাংক ইউ? সত্যি? নাকি আমাকে খুশী করার জন্য বলছেন?”
“সত্যি বলছি। থ্যাংক ইউ।”
“আমি আরো ভাবছি-”
মানুষটা রত্নাকে থামিয়ে বলল, “তোমার সাথে কথা বলতে বলতে আমার খুব অবাক একটা ফিলিংস হয়েছে। অবাক।”
“কী ফিলিংস?”
“মনে হয়েছে নীলা নাই, টুটুল নাই। এখন তাদের কী আছে জান? শুধু তাদের স্মৃতি-যখন আমি থাকব না তখন সেই স্মৃতিটাও থাকবে না। পৃথিবীতে নীলা আর টুটুলের কিছু থাকবে না।”
“তার মানে তার মানে—”
“তার মানে আমার মনে হচ্ছে, আমি পৃথিবীতে আরও কিছুদিন নীলা আর টুটুলের স্মৃতিটা রেখে দিই, কী বল?”
রত্না কিছু বলল না। বলার কিছু খুঁজে পেলো না। মানুষটা বলল, “কী হল? কিছু বলবে না?”
রত্না ভেউভেউ করে কাঁদতে লাগল। শুনতে পেলো অন্য পাশ থেকে এক সময় টুক করে লাইনটা কেটে গেছে।
রত্না টেলিফোনটা রেখে টেবিলে মাথা রেখে ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদতে থাকে। একটু পর রুনু দরজা একটু ফাঁক করে উঁকি দিল, জিজ্ঞেস করল, “আসব?”
রত্না কাঁদতে কাঁদতে বলল, “আস।”
রুনু এবং তার পিছু পিছু ইমরান আর রাজু এসে ঢুকলো। রুনু রত্নার মাথায় হাত রেখে নরম গলায় বলল, “কাদার কিছু হয় নাই। কগ্রাচুলেশনস। রত্না তুমি একজনের প্রাণ বাঁচিয়েছ।”
রত্না অবাক হয়ে তাকালো। বলল, “তুমি কেমন করে জান?”
রুনু ফিস ফিস করে বলল, “জানি। যখন কেউ একজন মানুষের প্রাণ বাঁচায় তখন সে এই ভাবে হাউমাউ করে কাঁদে।”
. ঠিক তখন আবার টেলিফোনটা বেজে উঠল।