ঠিক তখন বড় বড় ফোঁটায় বৃষ্টি পড়তে শুরু করল। জুলহাজ আকাশের দিকে তাকালো। পুরো আকাশটা বিজলীর ঝলকানীতে একবার ঝলসে ওঠে। মুহূর্তের জন্যে চারিদিক স্পষ্ট দেখা যায় তারপর আবার অন্ধকারে ডুবে যায়।
জুলহাজ বৃষ্টির মাঝে দাঁড়িয়ে থাকে। নীলা নেই, থাকলে এখন কী খুশিই না হতো। অনেকদিন ভেবেছিল টুটুলকে নিয়ে তারা তিনজন বৃষ্টিতে ভিজবে। ভেজা হয়নি। আর কখনো ভেজা হবে না। জুলহাজের বুকের ভেতরটা হঠাৎ কীভাবে জানি মোচড় দিয়ে ওঠে। বিচিত্র একটা কষ্ট, একটা শূন্যতা বুকের ভেতর খাঁখাঁ করতে থাকে। কার্নিশ থেকে লাফ দিয়ে নিচে পড়লেই সব কষ্ট সব শূন্যতা এক মুহূর্তে শেষ হয়ে যাবে।
জুলহাজ নিচের দিকে তাকালো। এখনো টেলিফোনটা ধরে রেখেছে। মেয়েটা কিছু একটা বলছে। অর্থহীন কোনো একটা প্রশ্ন। সময় কাটানোর জন্যে কোনো একটা কথা।
হঠাৎ কী হল কে জানে জুলহাজ হাউমাউ করে কেঁদে উঠল। নীলা আর টুটুল চলে যাবার পর সে একবারও কাঁদেনি। একবারও না। মনে হল জমে থাকা সব কান্না একবারে বের হয়ে আসছে।
জুলহাজ ঠোঁটে কামড় দিয়ে কান্না থামানোর চেষ্টা করতে থাকে। টেলিফোনের অন্যপাশে বাচ্চা একটা মেয়ে শুনছে সে কাঁদছে। শুনুক, কিছুতেই আর কিছু আসে যায় না।
৭. রত্না টেলিফোনটা শক্ত করে ধরে রাখে
রত্না টেলিফোনটা শক্ত করে ধরে রাখে। অন্যপাশে মানুষটা কাঁদছে। বড় একজন মানুষ কাঁদছে। মানুষটা কান্না থামানোর কোনো চেষ্টা করছে না। রত্নার শরীরটা কেমন জানি ঝিম ঝিম করতে থাকে, মনে হতে থাকে তার শরীরটা অবশ হয়ে আসছে। হঠাৎ করে তার ভেতরে তীব্র একটা অপরাধবোধ এসে ভর করে। তার মনে হতে থাকে সে খুব বড় একটা অন্যায় করে ফেলছে। না বুঝে না জেনে সে একজন মানুষের বুকের ভেতরের গভীর একটা যন্ত্রণার মাঝে হাত দিয়ে ফেলেছে। কে তাকে সেই অধিকার দিয়েছে? সে কেমন করে একজন মানুষের যন্ত্রণাটুকু টেনে বের করে এনেছে? এতো বড় নির্বোধ সে কেমন করে হলো?
রত্না টেলিফোনটা কান থেকে সরিয়ে তাকে ঘিরে দাঁড়িয়ে থাকা সবার দিকে তাকালো। রুনু ঝুঁকে পড়ে ফিস ফিস করে বলল, “কিছু বলবে?”
রত্না মাথা নাড়ল। বলল, “হ্যাঁ। আমি একা কথা বলতে চাই।”
“একা?”
“হ্যাঁ। প্লীজ। আপু তোমরা ঘরটা খালি করে দেবে?”
রুনু উঠে দাঁড়াল, বলল, “ঠিক আছে।” সে কিছুক্ষণ রত্নার চোখের দিকে তাকিয়ে রইল। তারপর নরম গলায় বলল, “মনে রেখো। একেবারে শেষ মুহূর্তে কিন্তু কোনো নিয়ম নাই। তুমি যেটা বলতে চাও বলো, যেটা করতে চাও করো। সব প্রটোকল ভুলে যাও। এখন প্রটোকল একটা। তুমি একটা মানুষ-সেও একটা মানুষ। বুঝেছ?”
রত্না মাথা নাড়ল। বলল, “থ্যাংক ইউ আপু।”
ছোট ঘর থেকে সবাই বের হয়ে যাওয়ার পর রত্না টেলিফোনটা কানে লাগালো। মানুষটা এখনো কাঁদছে। রত্না নরম গলায় ডাকলো, বলল, “শুনছেন।”
মানুষটা মনে হয় কিছু একটা বলার চেষ্টা করল, রত্না ঠিক বুঝতে পারল না। সে আবার বলল, “আপনি শুনছেন? আমি একটা কথা বলি? খুব ইম্পরট্যান্ট। আমাকে বলতেই হবে। প্লীজ।”
মানুষটা একটু শান্ত হল। বলল, “বল।”
“আপনি আমাকে মাপ করে দেন। প্লীজ। আমি আপনার কাছে মাপ চাই।”
মানুষটা মনে হয় একটু অবাক হল, বলল, “মাপ চাও? কেন?”
“আমি খুবই বোকা একটা মেয়ে। স্টুপিড বলতে পারেন। আমি ভেবেছি আমি সবকিছু জানি আর বুঝি। আমি ভেবেছি আমি আপনার সাথে কথা বলে আপনাকে সান্ত্বনা দিতে পারব। আসলে আমি উল্টো আপনার ভেতরের সব কষ্টটাকে বের করে এনেছি। আমি সরি। আমি আসলেই সরি।
“তোমার সরি হওয়ার কিছু নাই। আমার হঠাৎ করে টুটুলের কথা মনে পড়ে গেল-” মানুষটা আবার শব্দ করে কাঁদতে থাকে।
“আমি সরি। আমি খুবই সরি। আপনাকে কিছু বলতে হবে না। আমি গাধা একটা মেয়ে সেই জন্যে আপনাকে জোর করে কথা বলিয়েছি। না বুঝে আপনাকে কষ্ট দিয়েছি আমার মরে যেতে ইচ্ছা করছে।”
মানুষটা রত্নার কথা শুনতে পেল কিনা বোঝা গেল না, বলল, “টুটুল যখন ছোট ছিল তখন–যখন বাসায় আসতাম সন্ধ্যাবেলা, তখন সে হামাগুড়ি দিয়ে ছুটে আসতো। আমাকে দেখে কী খুশী হতো-মনে হতো বেঁচে থাকাটা স্বার্থক। এই পৃথিবীতে কেউ একজন আমাকে এতো ভালোবাসে। এখন-”
রত্না ধরা গলায় বলল, “আপনি আর বলবেন না প্লিজ। প্লিজ।”
“শোনো একটু। কাউকে একটু বলি। বুঝেছ পরী, গত ছয় মাস কাউকে কিছু বলি নাই। আমি একবার হাসি নাই। একটুও কাঁদি নাই। তুমি বাচ্চা একটা মেয়ে–”
“বোকা একটা মেয়ে।” রত্না কথার মাঝখানে কথা বলল, “গাধা একটা মেয়ে।”
“যেটাই হোক। তুমি বাচ্চা একটা মেয়ে তোমার সাথে কথা বলতে গিয়ে হঠাৎ কী যে হলো কখনো কাঁদছি। কখনো হাসছি। এতোদিন কষ্টটা চাপা দিয়ে রেখেছিলাম, হঠাৎ করে কষ্টটা যেন বের হয়ে আসছে।”
“আমি এভাবে বের করতে চাই নাই। বিশ্বাস করেন–খোদার কসম।”
“কী বৃষ্টি হচ্ছে এখানে। ভিজে চুপচুপে হয়ে গেছি। বারবার নীলার কথা মনে হচ্ছে। এখন থাকলে কতো খুশী হতো। সবসময় বলতো টুটুলকে নিয়ে ভিজতে হবে, টুটুলকে নিয়ে ভিজতে হবে।”
“কখনো ভিজেন নি?”
“না ভিজা হয় নাই। আরো কতো কিছু হয় নাই। ভেবেছিলাম একদিন চিড়িয়াখানায় নিয়ে যাব–যাওয়া হয় নাই। ভেবেছিলাম একদিন নৌকা করে নদীতে নিয়ে যাব–নেওয়া হয় নাই। ভেবেছিলাম কাদায় মাখামাখি করে মাছ ধরতে যাব-যাওয়া হয় নাই। পাঁচ বছর তিন মাস সতেরো দিন খুবই কম সময়।”