মেয়েটা হঠাৎ থেমে গেল। জুলহাজ জিজ্ঞেস করল, “তোমার কী?”
“না। বলা যাবে না।”
“কেন?”
“আমাদের ব্যক্তিগত কথা বলা নিষেধ।”
“তুমি আমার ব্যক্তিগত কথা শুনতে পারবে কিন্তু আমি তোমার ব্যক্তিগত কথা শুনতে পারব না?”
“অনেকটা সে রকম।” মেয়েটা একটু থেমে বলল, “ইচ্ছা করলে আপনিও আমাদের ভলান্টিয়ার হতে পারেন, তাহলে আপনিও অন্যের ব্যক্তিগত কথা শুনতে পারবেন।”
“আমি তোমাদের ভলান্টিয়ার হয়ে যাব?”
“আপনি চাইলে হতে পারেন।”
“যাই হোক সেটা মনে হয় কাজ করবে না। আমি আসলে কার্নিশ থেকে লাফ দিব।”
মেয়েটা কয়েক সেকেন্ড চুপ করে রইল, তারপর বলল, “আমি আসলে কিছুক্ষণের জন্যে ভুলেই গিয়েছিলাম যে আপনি সুইসাইড করার কার্নিশে দাঁড়িয়ে আছেন।”
“আমি ভুলি নাই।”
“জী।”
“শুধু একটুক্ষণ অপেক্ষা করছি।”
“আমিও সেটা চাই। যতক্ষণ সম্ভব অপেক্ষা করেন-যত বেশী সম্ভব কথা বলেন।”
“আসলে বৃষ্টি আসছে। আমি বৃষ্টিটার জন্যে অপেক্ষা করছি। বৃষ্টিটাতে শেষবার ভিজে যাই। নীলা থাকলে খুশী হতো।”
“নীলা ম্যাডাম বৃষ্টিতে ভিজতে পছন্দ করতেন।”
জুলহাজ একটা নিঃশ্বাস ফেলল, তারপর বলল, “খুব।”
“বৃষ্টিতে ভেজার একটা ঘটনার কথা বলবেন?”
জুলহাজ একটু ইতস্তত করে বলল, “আসলে বলার মত সেরকম ঘটনা নাই।”
“তাহলে অন্য কোনো ঘটনা। কোনো মজার ঘটনা।”
“তুমি সত্যিই মনে করো, এই রাতের বেলা কার্নিশের উপর দাঁড়িয়ে আমি একটা মজার ঘটনা বলতে পারব?”
“চেষ্টা করলেই পারবেন।”
“তুমি পারবে?” মেয়েটা একটু অবাক হয়ে বলল, “আমি?”
“হ্যাঁ। তুমি?”
“আমি? আমি-মানে, আমি-আসলে আমার কথা তো আসছে না।”
“পারবে না। একজনকে মজার ঘটনা বলতে বললেই সে বলতে পারে না।”
মেয়েটা কয়েক সেকেন্ড চুপ করে থেমে বলল, “যদি আমি বলি তাহলে আপনি বলবেন?”
“সেটা আমি কথা দিতে পারব না।”
“ঠিক আছে কথা না দিলেন, কথা না দিয়ে বলবেন।”
জুলহাজ চুপ করে রইল।
মেয়েটা গলা পরিষ্কার করে বলল, “আমি আমার একটা মজার ঘটনার কথা বলি। এই পরশুদিন এটা ঘটেছে। বলব?”
“বল।”
জুলহাজ পুরোপুরি বিশ্বাস করতে পারে না যে সে এখন এই মুহূর্তে সতেরো আঠারো বছরের বাচ্চা একটা মেয়ের জীবনের একটা মজার ঘটনার কথা শুনতে রাজী হয়েছে। সত্যি কথা বলতে কি ঘটানাটা কী শোনার জন্যে তার ভেতরে খানিকটা কৌতূহল হচ্ছে। কী আশ্চর্য!
মেয়েটা বলতে শুরু করল, “আমার খালা আমেরিকা থেকে অনেকদিন পর দেশে ফিরে এসেছে। সবার জন্যে অনেক গিফট এনেছে। আমার জন্যেও এনেছে। আমার জন্যে যে গিফট এনেছে তার একটা হচ্ছে মুখে দেওয়ার ক্রীম। এটা নাকি খুব দামী ক্রীম। মুখে দিলে মুখের চামড়ার মাঝে কী কী জানি হয়। ছোট একটা কৌটা দাম সাতাইশ ডলার। সাতাইশ ডলার মানে বুঝেছেন তো, প্রায় দুই তিন হাজার টাকা দাম।
“যাই হোক এতো দামী একটা ক্ৰীম আমি খুবই যত্ন করে ব্যবহার করি। নষ্ট না হয়ে যায় সেইজন্যে ফ্রীজের ভেতরে রেখেছি। একদিন রাত্রে ঘুমানোর আগে মুখে ক্রীম দিতে গিয়ে দেখি আমার পুরো কৌটাটা প্রায় খালি। কেউ একজন পুরোটা মেখে ফেলেছে। আমি চিৎকার করে বললাম, ক্রীম! আমার ক্রীম কে মেখেছে?
“প্রথমে কেউ স্বীকার করতে চায় না, তখন আমার নানী একটু লজ্জা পেয়ে বললেন, এইটা ক্রীম নাকী? আমি ভেবেছিলাম চুন, তাই পানের সাথে খেয়ে ফেলেছি। আমি চিৎকার করে বললাম, নানী তুমি মুখে দিয়েও বুঝো নাই এইটা ক্রীম? নানী বললেন, উঁহু! আমি ভেবেছি বিদেশী চুন। একটু মোলায়েম। তাই বেশী করে খেতে হয়েছে। সবাই নানীকে নিয়ে যখন হাসাহাসি করছি তখন নানী বললেন, জিনিসটা কিন্তু খেতে খারাপ না। চুনের মত ধাক নাই কিন্তু খেলে বাহ্যি পরিষ্কার হয়। মেয়েটা হি হি করে হাসতে হাসতে বলল, “বাহ্যি পরিষ্কার মানে বুঝেছেন?”
জুলহাজ বলল, “বুঝেছি।”
“গল্পটা মজার না?”
“হ্যাঁ, মজার।”
মেয়েটা কিচুক্ষণ চুপ করে থেকে বলল, “এখন আপনি কী একটা মজার ঘটনার কথা বলবেন?”
“সে রকম মজার ঘটনার কথা তো মাথায় আসছে না।”
“যেটাই আসে সেটাই বলেন। মজার না হলেও ক্ষতি নাই, যে কোনো ঘটনা। সুইট একটা ঘটনা-”
“একদিন সন্ধ্যেবেলা অফিস থেকে বাসায় এসেছি।” জুলহাজ নিজের কানকে বিশ্বাস করতে পারল না যখন দেখল সে সত্যিই মেয়েটাকে একটা মজার ঘটনার কথা বলার চেষ্টা করছে। জুলহাজ হঠাৎ করে চুপ করে গেল।
মেয়েটা বলল, “বলেন। তারপর কী হল?”
জুলহাজ বলতে শুরু করল, “বাসায় এসে দেখি নীলা রেগে ফায়ার। দাঁত কিড়মিড় করে বলল, তোমার ছেলে আজকে কী করেছে জান? টুটুল তখন খুবই ছোট। মাত্র হাঁটতে শিখেছে। সারাক্ষণ হেঁটে বেড়ায়। এত ছোট ছেলে কী করেছে আমি বুঝতে পারলাম না। জিজ্ঞেস করলাম, কী করেছে? নীলা বলল, দুপুর বেলা শুয়েছি, হঠাৎ একটু কাশি উঠেছে। তোমার ছেলে জিজ্ঞেস করল, পানি খাবে আম্মু? পানি খাবে? আমি বলেছি, খাব। তোমার ছেলে তখন দৌড় দিয়ে গণ্ডাসে পানি এনে দিল, তাকে খুশী করার জন্য আমি পানিটা খেলাম। খাওয়ার পর মনে হল সে পানি কোথা থেকে আনবে? খাবার টেবিলে সে তো পানির বোতল নাগাল পায় না। আমি জিজ্ঞেস করলাম, তাহলে কোত্থেকে এনেছে? নীলা চিৎকার করে বলল, যেখানে নাগাল পায় সেখান থেকে এনেছে। কমোড থেকে।”
জুলহাজ কথা শেষ হবার আগেই টেলিফোনের অন্য পাশ থেকে মেয়েটা হি হি করে হাসতে থাকে। মেয়েটার হাসি শুনে জুলহাজও একটুখানি হেসে ফেলল। হেসে ফেলে সে অবাক হয়ে দাঁড়িয়ে রইল। সে কি ভেবেছিল যে সে আবার কোনোদিন হাসবে? কী আশ্চর্য!