দিনের আলো নিভে আরও অন্ধকার হয়ে এল, চারিদিকে মোটামুটি ঘুটঘুঁটে অন্ধকার। তার মাঝে সবাই হৈচৈ করে কাজ করতে থাকে। দমকা হাওয়া আরও বেড়েছে, মাঝে মাঝে মনে হয় সবকিছু উড়িয়ে নেবে, কিন্তু সবাই মিলে শক্ত করে ধরে রেখে ক্রু এঁটে দিতে থাকে। ঝড়বৃষ্টি না হলে এই কাজটি আরও অনেক সহজে করা যেত, দিনের আলো হলে ঠিক কীভাবে পুরো জিনিসটি দাঁড় হচ্ছে দেখা যেত। কিন্তু এখন তার কোনো উপায় নেই। হারুন ইঞ্জিনিয়ারের সংখ্যাকে অন্ধের মতো বিশ্বাস করে সবাই কাজ করে যেতে থাকে।
ভোররাতের দিকে শেষ শ্রুটি লাগিয়ে হারুন ইঞ্জিনিয়ার একটা জয়ধ্বনির মতো শব্দ করলেন। উপস্থিত যারা ছিল তারাও সবাই আনন্দে চিৎকার করতে থাকে। পুরো কাজটুকু শেষ হয়েছে। কেউ সত্যি সত্যি বিশ্বাস করেনি যে এই কাজটি সত্যি কখনো শেষ হবে।
বাসায় যখন সবাই ফিরে এসেছে তখন আর কারও গায়ে তিল পরিমাণ জোর অবশিষ্ট নেই। ভিজে কাপড় পালটে শুকনো কাপড় পরে যে যেখানে ছিল সেখানেই লম্বা হয়ে শুয়ে পড়ল।
সারারাত ঝড়ের বেগ বাড়তে থাকে, সবাই সন্দেহ করতে থাকে যে হয়তো আবার একটা ভয়ংকর ঘূর্ণিঝড় আসছে। কিন্তু দেখা গেল শেষ মুহূর্তে ঘুর্ণিঝড়টা তার দিক পালটে জনবিরল একটা অংশের দিকে গিয়ে হাজির হয়েছে। সকালবেলা ঝড় কমে গিয়ে মোটামুটি শান্ত আবহাওয়া ফিরে এল। ফরাসত আলি, ফারুখ বখত আর হারুন ইঞ্জিনিয়ার টানা ঘুমে দিন কাবার করে দিতে পারতেন, কিন্তু একটু বেলা হতেই অনেক মানুষের হৈচৈ শুনে তাদের উঠে পড়তে হল। দরজা খুলে দেখেন অনেক মানুষজন তাদের বাসার সামনে, সবাই একসাথে তাদেরকে কিছু-একটা বলতে চাইছে বলে কিছুই আর শুনতে পাচ্ছেন না। তারা গতরাতে যে স্কুলটা দাঁড় করিয়েছেন সেটা নিয়ে কিছু-একটা বলছে। লোকজনের কথা শুনে কিছু বুঝতে না পেরে তারা তাদের স্কুলের দিকে রওনা দিলেন, তাঁদের বাসার খুব কাছে, হেঁটে যেতে দশ মিনিট।
মোড়টা ঘুরতেই তাদের স্কুলটা চোখে পড়ল। উজ্জ্বল রং, গতরাত্রে বৃষ্টিতে ধুয়ে এখন একেবারে ঝকমক করছে। সবুজ মাঠের উপর দাঁড়িয়ে আছে দেখে চোখ জুড়িয়ে যায়। গাঢ় লাল রঙের ছাদ, হালকা নীল রঙের দেয়াল, জানালা আর দরজায় কচুপাতা সবুজ রং। কাঁচের জানালা দিয়ে ভিতরের উজ্জ্বল ধবধবে সাদা দেয়াল দেখা যাচ্ছে। দেয়ালে ব্ল্যাকবোর্ড, মেঝেতে পাকাঁপাকিভাবে লাগানো চেয়ার টেবিল বেঞ্চ। কী সুন্দর উজ্জ্বল তাদের রং দেখলেই মনের মাঝে আনন্দ হতে শুরু করে। পুরো স্কুলটিতে কোনো ত্রুটি নেই, এক কথায় অপূর্ব। শুধু একটিমাত্র সমস্যা–
পুরো স্কুলটি দাঁড়িয়ে আছে কাত হয়ে। রাতের অন্ধকারে তাড়াহুড়ো করে লাগানোর সময় কেউ লক্ষ করেনি যে অংশটি পূর্ব থেকে পশ্চিমে বিস্তৃত হওয়ার কথা ছিল সেটা নিচে থেকে উপরে বিস্তৃত হয়ে আছে। দেখে মনে হচ্ছে কোনো এক বিশাল দৈত্য বুঝি স্কুলটিকে মাটি থেকে তুলে কাত করে দাঁড় করিয়ে দিয়েছে।
হারুন ইঞ্জিনিয়ার তার ভারী কাঁচের চশমা খুলে শার্টের হাতা দিয়ে মুছতে মুছতে বললেন, “শালার এক নম্বর অংশটা ডাইনে বামে রাখার কথা ছিল, রেখেছি উপরে নিচে-পুরোটাই এখন উপর নিচু হয়ে গেছে!”
ফরাসত আলি এবং ফারুখ বখত হা করে মাটি থেকে আকাশের দিকে উঠে যাওয়া কাত হয়ে থাকা স্কুলের দিকে তাকিয়ে রইলেন!
০৩. সবাই মিলে যখন কাত হয়ে
সবাই মিলে যখন কাত হয়ে থাকা স্কুলের দিকে তাকিয়ে আছেন তখন ভিড় ঠেলে একজন মানুষ এগিয়ে এলেন। মানুষটিকে দেখলে প্রথমেই যে-কথাটি বলতে হয় সেটা হচ্ছে যে মানুষটা মোটা। কোনো মানুষ যদি কানা খোঁড়া হয় কখনো তাকে কানা খোঁড়া বলতে হয় না। কোনো মানুষ যদি মোটা হয় তাকেও মোটা বলা ঠিক নয়, কিন্তু এই মানুষটিকে মোটা না বলে কোনো উপায় নেই। তাঁর হাত পা মোটা মোটা থামের মতো, তার বিশাল পেট উঁচু হয়ে আছে। তার বিশাল মুখে মোটা মোটা গাল চোখ নাক মুখ মনে হয় অনেক কষ্ট করে কোনোরকমে সেখানে টিকে আছে। মানুষটি একটু হাঁটলেই তার সারা শরীরের মেদ মাংস ভুড়ি থরথর করে কাঁপতে থাকে। মানুষটি ভিড় ঠেলে সামনে এসে হাঁপাতে লাগলেন। মানুষটি এত মোটা যে তার এই বিশাল শরীর নিয়ে একপা হাঁটা শুকনো পাতলা একজন মানুষের দুই মাইল দৌড়ে আসার সমান। খানিকক্ষণ বড় বড় নিঃশ্বাস নিয়ে মোটা মানুষটি বললো, “এখানে ফরা ভাই ফারু ভাই আর হারু ভাই কে?”
ফরাসত আলি বললেন, “আমি ফরাসত আলি।”
ফারুখ বখত বললেন, “আম ফারুখ বখত।”
হারুন ইঞ্জিনিয়ার বললেন, “আমি হারুন ইঞ্জিনিয়ার।”
মোটা মানুষটি বড় বড় দুইটা নিঃশ্বাস নিয়ে বললেন, “আমার নাম মির্জা মাস্টার।” কথাটি বলেই তাঁর নিঃশ্বাস ফুরিয়ে গেল, তিনি মুখ হাঁ করে নিঃশ্বাস নিতে লাগলেন।
ফারুখ বখত জিজ্ঞেস করলেন, “আপনি কিসের মাস্টার?”
“বাচ্চাদের। আমি বাচ্চাদের পড়াই।”
“কোথায় পড়ান?”
“স্কুলে।”
”কোথায় স্কুল?”
“স্কুল নেই।”
“স্কুল নেই? ফারুখ বখত অবাক হয়ে বললেন, বুঝতে পারলাম না, আপনি স্কুলে পড়ান, কিন্তু আপনার স্কুল নেই?”
“ছিল। স্কুল ছিল। গতরাতে ঝড়ে উড়ে গেছে।”
ফরাসত আলি বললেন, “গতরাতে তো বেশি বড় ঝড় হয়নি! এই ঝড়ে স্কুল উড়ে গেল?”
মির্জা মাস্টার তখন একটু হাসার চেষ্টা করে বললেন, “খুব দুর্বল স্কুল ছিল। বাঁশের চাটাই দিয়ে ঢেকে উপরে একটা ছাউনি। আমি জোরে একটা হাঁচি দিলে স্কুল উড়ে যায় সেরকম অবস্থা।”