হারুন ইঞ্জিনিয়ার পরিশ্রমী মানুষ। সারাদিন খেটেখুটে কাজ করে রাতে বাসায় ফিরে এসেও বিশ্রাম নেন না। পাবদা মাছের ঝোল দিয়ে এক গামলা ভাত খেয়ে স্কুলঘর ডিজাইন করতে শুরু করেন। একটা মাঝারি কম্পিউটার কেনা হয়েছে–সেখানে তিনি স্কুলঘরের নকশা করতে থাকেন। চারিদিকে বড় বড় জানালা, ছাত্রদের জন্যে বেঞ্চ, মাস্টারদের জন্যে চেয়ার-টেবিল, দেয়ালে ব্ল্যাকবোর্ড। ছোট ক্লাসের জন্যে ক্লাসঘরের মাঝে নানারকম খেলাধুলার ব্যবস্থা।
হারুন ইঞ্জিনিয়ারের কাজ দেখে ফারুখ বখত আর ফরাসত আলিও উৎসাহ পেয়েছেন। তাঁরা ঘোরাঘুরি করে স্কুলের জন্যে জায়গা খুঁজতে লাগলেন। শহরের মাঝামাঝি ফাঁকা জায়গা পাওয়া এত সহজ নয়, শহরের বেশি বাইরেও তারা যেতে চান না। জায়গা পছন্দ হবার পরেও নানারকম যন্ত্রণা। সেটি দলিল করতে হয়, তার দখল নিতে হয়। তবুও কাজকর্ম মোটামুটি এগিয়ে যেতে থাকল।
প্লাস্টিজনার টুকরো দিয়ে স্কুলঘর তৈরি শুরু হয়েছে। ছোট ছোট টুকরো একসাথে জুড়ে বড় দেয়াল তৈরি হচ্ছে, চার দেয়াল লাগিয়ে ঘর। উপরে ছাদ নিচে মেঝে। দিনরাত লোকজন কাজ করছে, ড্রিল দিয়ে ফুটো করা হচ্ছে, দিয়ে লাগানো হচ্ছে, ইলেকট্রিক করাত দিয়ে কাটা হচ্ছে, হাতুড়ির শব্দ, জিনিসপত্র টানাটানির হৈহুল্লোড়, সব মিলিয়ে একটা আনন্দোৎসবের মতো অবস্থা।
হারুন ইঞ্জিনিয়ার বলেছিলেন ছয় মাসের মাঝে স্কুলঘর দাঁড় করিয়ে দেবেন। অবিশ্বাস্য ব্যাপার–সত্যি সত্যি ছয় মাসের আগেই সবগুলি স্কুলঘর দাঁড়িয়ে গেল। দরজা-জানালা, ব্ল্যাকবোর্ড, বেঞ্চ, চেয়ার-টেবিল সবকিছু একসাথে। উজ্জ্বল রং দিয়ে সবকিছু রং করা হয়েছে, এত সুন্দর রং দেখলেই মন ভালো হয়ে যায়। সবারই কাজকর্মে খুব উৎসাহ। ছয় মাসের আগেই সব শেষ হয়ে যাবে তাতে কোনো সন্দেহ নেই। কাজকর্ম মোটামুটি শেষ, এখন সেগুলি স্কুলের জায়গায় নিয়ে লাগিয়ে দেয়া-সেটা নাকি একেবারে সহজ একটা কাজ, হারুন ইঞ্জিনিয়ারের ভাষায় একেবারে পাবদা মাছের ঝোল!
ঠিক তখন হঠাৎ রাতের খবরে শোনা গেল সমুদ্রে একটা নিম্নচাপ দেখা দিয়েছে, একটা ঘূর্ণিঝড় এগিয়ে আসছে। এখনও সেটা সমুদ্রের গভীরে, কিন্তু দুদিনের মাঝে এসে এখানে ঝাঁপটা দেবে। হারুন ইঞ্জিনিয়ার মাথা চুলকে বললেন, “অবস্থা গুরুতর।”
ফারুক বখত জিজ্ঞেস করলেন, “কেন কী হয়েছে?”
“প্লস্টিজনার এক নম্বর গুণ হচ্ছে এটা হালকা। আস্ত একটা স্কুলঘর দুইজন মানুষ মিলে টেনে নিয়ে যেতে পারে! তার মানে বুঝেছ?”
ফারুখ বখত মাথা চুলকে বললেন, “না, বুঝিনি।”
“তার মানে ঘরগুলি যদি ঠিক করে বেঁধেহেঁদে রাখা না হয় তাহলে ঝড়ে সেগুলি উড়ে একেবারে গারো পাহাড়ে গিয়ে পড়বে!”
“তা হলে, বেঁধেহেঁদে রাখলেই হয়।”
হারুন ইঞ্জিনিয়ার তাঁর ভারী চশমা খুলে শার্টের হাতায় মুছতে মুছতে বললেন, “আমি অন্য একটা জিনিস ভাবছি।”
“কী জিনিস?”
“সবগুলি স্কুলঘর তৈরি হয়ে গেছে, এগুলিকে এখন শক্ত করে বাঁধাছাদা করতে যত সময় লাগবে সবগুলিকে স্কুলের মাঠে নিয়ে পাকাঁপাকিভাবে বসিয়ে দিতে মোটামুটি একই সময় লাগবে।”
“সত্যি?”
“সত্যি। আমি তাই ভাবছি এক কাজ করলে কেমন হয়?”
“কী কাজ?”
“ঘূর্ণিঝড় আসার আগেই স্কুলঘরগুলিকে স্কুলের মাঠে নিয়ে পাকাঁপাকিভাবে বসিয়ে দিলে কেমন হয়?”
“এখনই?”
“হ্যাঁ।”
ফরাসত আলি আর ফারুখ বখত দুজনেই এতদিনে এর মাঝে টের পেয়েছেন হারুন ইঞ্জিনিয়ারের মাথায় একটা-কিছু ঢুকে গেলে সেটা সেখান থেকে বের করা খুব সহজ না। প্রথম প্রথম চেষ্টা করেছিলেন, আজকাল আর চেষ্টা করেন না। ফারুখ বখত বললেন, “ঠিক আছে তা হলে কাজ শুরু করে দেয়া যাক!”
হারুন ইঞ্জিনিয়ার তার ভারী চশমার কাঁচ শার্টের হাতা দিয়ে মুছতে মুছতে বললেন, “কাজ খুব সহজ, একেবারে পাবদা মাছের ঝোল! সবকিছুতে নাম্বার দেয়া আছে। এক নম্বরের সাথে এক নম্বর, দুই নম্বরের সাথে দুই নম্বর, তিন নম্বরের সাথে তিন নম্বর এইভাবে লাগিয়ে যাবে দেখতে দেখতে কাজ শেষ হয়ে যাবে।”
ফরাসত আলি তার দাড়ি চুলকাতে চুলকাতে বললেন, “তা হলে আর দেরি করে কাজ নেই, লোকজন ডেকে কাজ শুরু করে দিই।”
বাইরে আকাশে তখন মেঘ করেছে, একটু একটু ঠাণ্ডা বাতাস এবং খুব সূক্ষ্ম বোঝা যায় না এরকম বৃষ্টি। কিন্তু তাতে কেউ পিছপা হল না এবং তার মাঝে কাজ শুরু হয়ে গেল। একটা ট্রাক, কয়েকটা গোরুর গাড়ি এবং বেশকিছু রিকশা দিয়ে স্কুলঘরগুলি তুলে নেয়া হল। মাঠের মাঝে আগে থেকে দাগ কাটা ছিল সেখানে বসিয়ে সেগুলিকে মোটা মোটা ক্রু দিয়ে গেঁথে দেয়া আরম্ভ হল। কাজ শুরু করার কিছুক্ষণের মাঝেই আকাশ ধীরে ধীরে একেবারে পুরোপুরি অন্ধকার হয়ে তুমুল বৃষ্টি শুরু হল। দমকা বাতাসটাও মনে হয় বেড়ে গেল কয়েকগুণ। কিন্তু একবার কাজ শুরু করে দেয়া হয়েছে, এখন থামার উপায় নেই। দিনের বেলাতেই মোটামুটি অন্ধকার, বড় বড় কয়েকটা টর্চলাইট হাতে সবাই কাজ করতে থাকে। সবার গায়েই একটা করে রেনকোট রয়েছে কিন্তু তবু সবাই ভিজে একেবারে চুপসে গেল।
এরকম ঝড়বৃষ্টিতে আদৌ এ ধরনের কাজ করা সম্ভব সেটা বিশ্বাস করা শক্ত। কিন্তু হারুন ইঞ্জিনিয়ারের কাজ মোটামুটি নিখুঁত। সবকিছুর মাঝে বড় বড় উজ্জ্বল রঙের নাম্বার দেয়া রয়েছে, নাম্বারগুলি মিলিয়ে একটার মাঝে আরেকটা শুধু ক্রু দিয়ে এঁটে দেয়া। টর্চলাইট জ্বালিয়ে বৃষ্টিতে ভিজে সবাই কাজ করতে থাকে এবং দেখতে দেখতে স্কুলঘর দাঁড়িয়ে যেতে থাকে।