হারুন ইঞ্জিনিয়ার জিনিসটা হাতে নিয়ে বক্তৃতা দেয়ার মতো করে বললেন, “এর হিট কনডাক্টিভিটি সিরামিকের, স্পেসিফিক গ্র্যাভিটি কাগজের কিন্তু টেনসিল স্ট্রেংথ ইস্পাতের।”
ফরাসত আলি কিছু না বুঝে মাথা নাড়লেন। হারুন ইঞ্জিনিয়ার গলার স্বর আরো উঁচু করে বললেন, “এটা করাত দিয়ে কাটা যায়, ড্রিল দিয়ে ফুটো করা যায়, কিন্তু পানি দূরে থাকুক অ্যাসিড দিয়েও গলানো যায় না। বৃষ্টিতে ভিজবে না, আগুনে পুড়বে না।”
ফরাসত আলি চমৎকৃত হয়ে তাকিয়ে ছিলেন, জিজ্ঞেস করলেন, “জিনিসটা আপনি তৈরি করছেন?”
“অবশ্যি! আমার দশ বছরের সাধনা! দশ বছর আগে আমি একদিন মগবাজার থেকে হেঁটে আসছি, দেখি রাস্তার কাছে তূপ হয়ে আছে আবর্জনা, দুর্গন্ধে নাড়ি উলটে আসে! আমি ভাবলাম এই যদি আবর্জনার নমুনা হয় একদিন এই দেশ আবর্জনায় তলিয়ে যাবে। দেশের জন্যে যদি কিছু করতে হয় এই আবর্জনার একটা গতি করতে হবে। সেই থেকে আমি আবর্জনা নিয়ে গবেষণা করছি।”
“আবর্জনা নিয়ে?”
“হ্যাঁ। লোকজন আমাকে নিয়ে হাসাহাসি করেছে। আবর্জনা নিয়ে কাজ করতাম বলে আমার শরীর থেকে সব-সময় দুর্গন্ধ বের হত। একদিন আমার বউ আমাকে ছেড়ে চলে গেল। রেস্টুরেন্টে গেলে তোকজন উঠে যেত, বাসে উঠলে বাসের লোকজন নেমে যেত, কিন্তু আমি ছেড়ে দিইনি। দশ বছরের গবেষণার ফল এই পাস্টিজনা!”
“প্লাস্টিজনা?”
“হ্যাঁ, পাস্টিক এবং আবর্জনা। প্রস্টিজনা। নামটা ভালো হয়নি?”
ফরাসত আলি মাথা নাড়লেন, “ভালো হয়েছে।”
“সারা পৃথিবীতে আবর্জনা নিয়ে সমস্যা, আর আবর্জনার বেশির ভাগ হচ্ছে পাস্টিক। এক ঢিলে মানুষ দুই পাখি মারে, আমি তিন পাখি মেরেছি, আবর্জনার গুষ্ঠি উদ্ধার করে ছেড়েছি পাস্টিকটা ব্যবহার করেছি আর সেটা দিয়ে তৈরি করেছি প্লাস্টিজনা! ঠিক কি না?”
ফরাসত আলি মাথা নাড়লেন, “ঠিক।”
“এবার তা হলে কাজের কথায় আসি।”
“কাজের কথা? ফরাসত আলি মনে-মনে ভাবলেন, এতক্ষণ তা হলে কি অকাজের কথা হচ্ছিল?
“হ্যাঁ, আমি এখন বলি আমি কেন এসেছি। আমি আমার প্লাস্টিজনা দিয়ে আপনার পুরো স্কুল তৈরি করে দেব। শুধু স্কুল না–স্কুলের দরজা জানালা চেয়ার টেবিল বেঞ্চ ব্ল্যাকবোর্ড সবকিছু। ছয় মাসের ভিতরে।”
“ছয় মাসের ভিতরে?”
“হ্যাঁ।”
“কিন্তু আমাদের স্কুলের জমি এখনে কেনা হয়নি!
হারুন ইঞ্জিনিয়ার একগাল হেসে বললেন, “আমার স্কুল তৈরি করতে জমি লাগে না। আপনি ধীরেসুস্থে জমি কেনেন।”
ফরাসত আলি দাড়ি চুলকে বললেন, “খরচ পড়বে কত?”
“খরচের কথা ভাববেন না। দরকার হলে আমি ফ্রি তৈরি করে দেব।”
“ফ্রি? ফ্রি কেন করে দেবেন?”
ভারী চশমার আড়ালে হারুন ইঞ্জিনিয়ারের চোখ হঠাৎ ভাবগম্ভীর হয়ে ওঠে, তিনি কাঁপা গলায় বললেন, “কারণ আমি পৃথিবীকে দেখাতে চাই আমার পাস্টিজনা দিয়ে পৃথিবীতে বিপ্লব করে দেয়া যায়!”
ফরাসত আলি জোরে জোরে মাথা নাড়লেন, বললেন, “অবশ্যি! অবশ্যি!”
হারুন ইঞ্জিনিয়ার বললেন, “পৃথিবীকে চমৎকৃত করার এই হচ্ছে সুযোগ। এখন বলেন আপনি রাজি কি না।”
ফরাসত আলি চুল এবং দাড়ি একসাথে চুলকে বললেন, “আমার তো মনে হচ্ছে আইডিয়াটা খুবই ভালো কিন্তু আমার বন্ধু ফারুখ বখতের সাথে কথা না বলে আমি তো কথা দিতে পারছি না!”
“কোনো চিন্তা নেই, আপনি তার সাথে কথা বলেন।”
“আপনাকে আমি কোথায় পাব?”
“এইখানে।”
“এইখানে?”
“হ্যাঁ। হারুন ইঞ্জিনিয়ার অমায়িকভাবে হেসে বললেন, “নতুন জায়গা, কিছু চিনি না, কোথায় উঠে কোন ঝামেলায় পড়ব, তাই আপনার বাসাতেই উঠে গেলাম। আমার খাওয়া নিয়ে কিছু চিন্তা করবেন না, আমি সবকিছু খাই। শুনেছি এখানকার পাবদা মাছ নাকি জগদ্বিখ্যাত?”
ফরাসত আলি মাথা নাড়লেন, সত্যি সত্যি এখানকার পাবদা মাছ জগদ্বিখ্যাত।
.
ফারুখ বখত সবকিছু শুনে আরও অনেক বেশি উৎসাহিত হলেন। প্রাস্টিজনার টুকরাটি দেখে আবেগে তাঁর চোখে পানি এসে গেল। তিনি হারুন ইঞ্জিনিয়ারকে একেবারে বুকে জড়িয়ে ধরে বললেন, “ভাই হারু, তোমার মতো আর কয়েকজন মানুষ হলেই এই দেশের ইতিহাস অন্যভাবে লেখা হত।”
ফারুখ বখতের কথা শুনে হারুন ইঞ্জিনিয়ারের ভারী চশমার কাঁচও ঝাঁপসা হয়ে এল। তিনি সেটা খুলে শার্টের হাতায় মুছতে মুছতে বললেন, “ভাই ফারু এবং ভাই ফরা, তোমরা দুইজন হলে প্রথম মানুষ যারা আমার এই আবিষ্কারের প্রকৃত মর্ম বুঝতে পারলে।”
ফরাসত আলি সাধারণত আবেগে কাতর হয়ে যান না, কিন্তু এই মুহূর্তে দুইজন মানুষকে এইভাবে কাঁদোকাঁদো হয়ে যেতে দেখে তিনিও একটু দুর্বল হয়ে গেলেন। ধরা গলায় বললেন, “ভাই হারু, তুমি কোনো চিন্তা কোরো না। দরকার হলে আমাদের তিরিশ লক্ষ টাকার শেষ পাই পয়সা খরচ করে এই প্লাস্টিজনাকে আমরা বাংলাদেশের ঘরে ঘরে পৌঁছে দেব।”
কয়েকদিনের মাঝেই মহা উৎসাহে প্রাস্টিজনার কাজ শুরু হল। শহরের বাইরে অনেকটুকু জায়গা নেয়া হল, পৌরসভার ট্রাক সেখানে শহরের আবর্জনা ফেলতে লাগল। নাকে রুমাল বেঁধে হারুন ইঞ্জিনিয়ার সেগুলি ঘাঁটাঘাঁটি করতে লাগলেন। বড় বড় ড্রামের নিচে আগুন জ্বলতে লাগল। তিনি সেখানে নানারকম ওষুধপত্র ঢালতে লাগলেন। হারুন ইঞ্জিনিয়ার আরও কিছু লোক নিয়েছেন, তারাও নাকে রুমাল বেঁধে প্লাস্টিকের বালতি করে কালচে একধরনের তরল এক ড্রাম থেকে অন্য ড্রামে ঢালাচালি করতে লাগল। মাটি দিয়ে একধরনের ছাঁচ তৈরি করা হয়েছে সেখানে মণ্ড ঢেলে দেয়া হল, সেগুলিকে চাপা দিয়ে চৌকোণা পাস্টিজনার টুকরো বের হতে লাগল। এক পাশে ছোট একটা ছাউনি করা হয়েছে–সেখানে কিছু যন্ত্রপাতি বসানো হয়েছে, প্রাস্টিজনার টুকরোগুলি সেখানে পরীক্ষা করা হয়, মেপে দেয়া হয়, কেটেকুটে ঠিক করা হয়। সকাল থেকে রাত পর্যন্ত কাজ চলছে, তিন ঘণ্টা পরপর চা খাওয়ার অবসর। বিরাট বড় কেতলিতে চায়ের পানি গরম। হচ্ছে, ছোট একটা ছেলে ছোট ছোট কাপে চা ঢেলে দিচ্ছে এবং হারুন ইঞ্জিনিয়ার তার দলবল নিয়ে চা খাচ্ছেন–এই দৃশ্যটিতে সবাই অভ্যস্ত হয়ে গেল।