লোকটি মাথা চুলকে বলল, “সেটা তো ঠিক জানি না।”
“তাহলে দরজায় ধাক্কা দিলেন যে–”
”ইয়ে মানে যাকে খুঁজছি সেই মানুষটার নাম-”
“কী নাম?”
ভারী চশমা চোখের মানুষটা আবার খানিকক্ষণ মাথা চুলকে বলল, “মনে হয় নাম ওরাফত।”
“ওরাফত? ওরাফত আবার কোন দেশি নাম?”
“জানি না কোন দেশি। তবে মানুষটা মনে হয় মেয়েমানুষ।”
“মেয়েমানুষ?” ফরাসত আলি তখন মাথা নেড়ে বললেন, “না ভাই, এই বাসায় কোনো মেয়েমানুষ থাকে না।”
ভারী চশমা চোখের মানুষটার তখন খুব আশাভঙ্গ হল বলে মনে হল, খানিকক্ষণ দরজায় দাঁড়িয়ে থেকে বলল, “আপনি হয়তো বলতে পারবেন কোথায় থাকে সেই মহিলা।
ফরাসত আলি মাথা চুলকে বললেন, “আমি আসলে খুব বেশি মহিলাকে চিনি।”
“এই মহিলাকে হয়তো চিনবেন। মনে হয় খুব দজ্জাল মহিলা।”
“দজ্জাল মহিলা?”
“হ্যাঁ। কারণ–” ভারী চশমা চোখের মানুষটি মাথা চুলকে বলল, “সবাই দেখি মহিলাটিকে একটা গালি না দিয়ে কথা বলে না।”
“তাই নাকি?”
“হ্যাঁ। মহিলার নাম ওরাফত, সবাই ডাকে ওরাফত শালী।”
ফরাসত আলি খুব অবাক হলেন, একজন মহিলা সে যত দজ্জালই হোক তাকে লোকজন শালী বলে ডাকবে তিনি বিশ্বাস করতে পারলেন না। জিজ্ঞেস করলেন, “মহিলা দেখতে কেমন?”
মানুষটি আবার তার মাথা চুলকে বলল, “সেটাও খুব অবাক ব্যাপার। তার মুখে নাকি দাড়ি-গোঁফ?”
“মহিলার মুখে দাড়ি-গোঁফ?”
”হ্যাঁ। লটারিতে কয়েকদিন আগে তিরিশ লক্ষ টাকা পেয়েছে।”
ফরাসত আলি চমকে উঠলেন, “লটারিতে তিরিশ লক্ষ টাকা পেয়েছে, মুখে দাড়ি-গোঁফ, নাম ওরাফত শালী?”
“হ্যাঁ।”
ফরাসত আলি হঠাৎ করে খুব গম্ভীর হয়ে বললেন, “বুঝেছি।”
“কি বুঝেছেন?”
“নাম বলেছেন ওরাফত শালী–আসলে সেটা ফরাসত আলি। ফরাসত আলি মোটেও দজ্জাল মহিলা না, পুরুষ মানুষ।”
“চেনেন আপনি?”
“চিনি। আমিই ফরাসত আলি।”
শুনে ভারী চশমা চোখের মানুষটি দাঁত বের করে আনন্দে হেসে ফেলল, হাত বের করে তার সাথে কয়েকবার জোরে জোরে হাত মিলিয়ে বলল, “আমার নাম হারুন ইঞ্জিনিয়ার। আমি আপনাকে কয়েকদিন থেকে খুঁজছি।”
“কেন?”
“আপনি যে স্কুল তৈরি করবেন তার বিল্ডিং তৈরি করার জন্য।”
ফরাসত আলি অবাক হয়ে হারুন ইঞ্জিনিয়ারের দিকে তাকালেন, “আপনি কেমন করে জানেন আমি স্কুল তৈরি করব? কাউকে তো বলিনি আমরা!”
হারুন ইঞ্জিনিয়ার আবার দাঁত বের করে হাসলেন।”কাউকে বলতে হয় নাকি, সবাই তো জানে।”
“সবাই জানে?”
“না জানার কী আছে? বড়লোকেরা লটারি জিতলে টাকাগুলি যক্ষের মতো আগলে রাখে। আর আমার আপনার মতো মানুষেরা লটারি জিতলে টাকাটা ভালো কাজে খরচ করে। স্কুল-কলেজ হাসপাতাল দেয়। গরিব আত্মীয়স্বজনের ছেলেপুলের পড়ার খরচ দেয়। দেয় না?”
ফরাসত আলি একটু হতচকিত হয়ে মাথা নাড়লেন। হারুন ইঞ্জিনিয়ার তার ভারী চশমাটা খুলে ভালো করে মুছে বললেন, “আপনি কী দেবেন? স্কুল-কলেজ হাসপাতাল?”
“স্কুল।”
“স্কুলটাই ভালো। দেশের কাজ হয়। বাচ্চাদের না বড়দের?”
“বাচ্চাদের।”
“সেটা আরও ভালো। হারুন ইঞ্জিনিয়ার এবারে ঘরের ভিতরে ঢুকে নিজেই একটা চেয়ারে আরাম করে বসে বললেন, “এবারে আমি বলি আমি কী জন্যে এসেছি।”
ফরাসত আলি কাছাকাছি আরেকটা চেয়ারে বসে নিজের চায়ের কাপটা টেনে নিয়ে বললেন, “বলেন।”
“বাড়িঘর কিভাবে তৈরি হয় তা আপনি জানেন?”
ফরাসত আলি দাড়ি চুলকাতে চুলকাতে বললেন, “ঠিক জানি না।”
“প্রথমে ফাউন্ডেশান তৈরি করতে হয়, তারপর পিলার লোহর রড দিয়ে শক্ত করতে হয়, কংক্রিট ঢেলে দিতে হয়। তারপর ছাদ ঢালাই, দেয়াল, তারপর দরজা-জানালা!”
ফরাসত আলি মাথা নাড়লেন।
“মনে করেন আপনি এভাবে একটা বাসা তৈরি করলেন। বাসা তৈরি শেষ হল, কয়েক বছর থাকলেন তখন আপনার মনে হল, নাহ্ এই ঘরটা এখানে না হয়ে ওখানে হলে ভালো হত। তখন আপনি কী করবেন?”
ফরাসত আলি কী করবেন বুঝতে না পেরে আবার দাড়ি চুলকালেন। হারুন ইঞ্জিনিয়ার খানিকক্ষণ তাঁর দাড়ি চুলকানো দেখে একগাল হেসে বললেন, “হ্যাঁ, আপনি দাড়ি চুলকাবেন। আর দাড়ি যদি না থাকে তা হলে আঙুল চুষবেন। কারণ একবার বাসা তৈরি হয়ে গেলে আর কিছুই করার নেই। কিন্তু আমি-হারুন ইঞ্জিনিয়ার নতুন একটা প্রসেস দাঁড় করিয়েছি, আমেরিকা জার্মানি আর জাপানে এর পেটেন্ট রয়েছে, এইভাবে বাসা তৈরি করা হলে, যখন খুশি খুলে সেটা নতুন করে লাগানো যায়। দরকার হলে নতুন জায়গায় নিয়ে যাওয়া যায়। শীতের সময় সূর্যের আলো ঢুকতে দিলেন, গরমের সময় বাসা ঘুরিয়ে সূর্যের দিকে পিছনে করে দিলেন। একতলা বাসা তৈরি করলেন, হঠাৎ খেলার জন্যে ব্যাডমিন্টন কোর্ট দরকার একটা ঘরের উপর আরেকটা ঘর তৈরি করে বাসাটাকে দোতলা করে বাসার সামনে খোলা মাঠ বের করে দিলেন।”
ফরাসত আলি চোখ বড় বড় করে হারুন ইঞ্জিনিয়ারের কথা শুনছিলেন, জিজ্ঞেস করলেন, “কী দিয়ে তৈরি করেন এই বাসা?”
হারুন ইঞ্জিনিয়ার টেবিলে একটা ছোট থাবা দিয়ে বললেন, “সেটাই হচ্ছে সিক্রেট, কিন্তু আপনাকে আমি বলব। আপনার কাছে কোনো সিক্রেট নাই। বাসা তৈরি হয় পাস্টিক দিয়ে।”
“প্লা-প্লা-পাস্টিকের বাসা?”
“হ্যাঁ। কিন্তু মনে করবেন না যেই প্লাস্টিক দিয়ে চিরুনি তৈরি হয় সেই পাস্টিক। এই দেখেন একটা স্যাম্পল!”
হারুন ইঞ্জিনিয়ার তার কাপড়ের ঝোলার মাঝে হাত দিয়ে কালোমতন একটা টুকরো বের করে নিয়ে এসে ফরাসত আলির হাতে দিলেন। ফরাসত আলি সেটা নেড়েচেড়ে দেখলেন। জিনিসটা পাতলা কাঠের মতো হালকা কিন্তু পাথরের মতো শক্ত। চকচকে একটা ভাব রয়েছে দেখে মনে হয় লোহা বা অ্যালুমিনিয়ামের তৈরি।