ফরাসত আলি শব্দ শুনে ছুটে এসে ফারুখ বখতকে এভাবে দেখে একেবারে আঁতকে উঠলেন। একটা হাতপাখা এনে বাতাস করতে করতে জিজ্ঞেস করলেন, “ফারুখ কী হয়েছে? কী হয়েছে তোর?”
ফারুখ বখত বড় বড় নিঃশ্বাস নিতে নিতে বললেন, “ল-ল-ল-”
“ল-ল-ল–কী?”
ফারুখ বখত আরও খানিকক্ষণ নিঃশ্বাস নিয়ে কোনোমতে বললেন, “টা-টা টা–”
ফরাসত আলি কিছু বুঝতে না পেরে অবাক হয়ে তার ছেলেবেলার বন্ধুর দিকে তাকিয়ে রইলেন। ফারুখ বখত সবসময়েই একটু পাগলাটে ছিলেন, ফরাসত আলির সন্দেহ হতে লাগল হয়তো এখন পুরোপুরি পাগল হয়ে গেছেন।
মিনিট পাঁচেক পর ফারুখ বখত ধাতস্ত হয়ে বললেন, “লটারি-লটারি?”
“লটারি?”
“হ্যাঁ। তোর লটারির টিকেট–”
”কি হয়েছে আমার লটারির টিকেট?”
”তোর টিকেট তিরিশ লক্ষ টাকা জিতেছে।”
শুনে ফরাসত আলি মাথা ঘুরে পড়ে যাচ্ছিলেন, কোনোমতে ফারুখ বখতকে ধরে সামলে নিলেন। বড় বড় কয়েকটা নিঃশ্বাস নিয়ে বললেন, “কী বললি? কী বললি?”
“তুই তিরিশ লক্ষ টাকা জিতেছিস লটারিতে!”
“সত্যি?”
“সত্যি। এই দ্যাখ খবরের কাগজে উঠেছে! চ ১১১১১১১১।”
ফরাসত আলি খবরের কাগজটা দেখে মাটিতে বসে পড়লেন। তাঁর হাত অল্প অল্প কাঁপতে লাগল, তাঁকে দেখে মনে হতে লাগল তার শরীর খারাপ হয়ে গেছে, এখনই বুঝি হড়হড় করে বমি করে দেবেন। দেখে ফারুখ বখত একটু ঘাবড়ে গেলেন, ফরাসত আলিকে আস্তে একটু ধাক্কা দিয়ে বললেন, “কী হল তোর?”
ফরাসত আলি ফ্যালফ্যাল করে ফারুখ বখতের দিকে তাকিয়ে রইলেন। ফারুখ বখত তার ঘাড়ে একটা থাবা দিয়ে বললেন, “একটু আনন্দ কর! তুই এখন তিরিশ লক্ষ টাকার মালিক।
“তি-তি-তিরিশ লক্ষ? এত টাকা দিয়ে আমি কী করব?”
“ধুর গাধা! টাকা দিয়ে মানুষ আবার কী করে! তুই খরচ করবি।”
“তিরিশ লক্ষ টাকা আমি খরচ করব? আমি একা?” ফরাসত আলি একেবারে কাঁদোকাঁদো হয়ে গেলেন, ফারুখ বখতের দিকে তাকিয়ে ভাঙা গলায় বললেন, “তুই অর্ধেক নিবি?”
“আ-আ-আমি।”
“হ্যাঁ।”
“আমি কেন?”
“তুই আমার বন্ধু সেজন্যে! তা ছাড়া তুই বলেছিলি তুই অর্ধেক লটারির টিকেট কিনবি, মনে নেই? তোর ন্যায্য পাওনা! নিবি তুই, অর্ধেক টাকা?”
ফারুখ বখত বুঝলেন বেশি উত্তজনায় তাঁর বন্ধুর মাথার ঠিক নেই। তিনি তাকে সান্ত্বনা দিয়ে বললেন, “ঠিক আছে তুই যদি দিতে চাস দিবি।”
ফরাসত আলি তখন মনে হয় বুকে একটু জোর পেলেন। ফারুখ বখতের হাত ধরে বললেন, “তুই কথা দে।”
এখানে আবার কথা দেওয়া না-দেওয়ার কী আছে? তিরিশ লক্ষ টাকা দিয়ে কত কী করা যায়, তুই এত ঘাবড়াচ্ছিস কেন? তুই কিছু চিন্তা করিস না, আমি সব ব্যবস্থা করে দেব। দরকার পড়লে আমি তোর সব টাকা খরচ করিয়ে দেব।”
“সত্যি দিবি? বুক ছুঁয়ে বল।”
“সত্যি দেব। এই দ্যাখ বুক ছুঁয়ে বলছি।”
ফরাসত আলি তখন প্রথমবার একটু হেসে উঠে দাঁড়ালেন। ফারুক বখতও তখন উঠে দাঁড়াতে গিয়ে ঊরু চেপে ধরে বসে পড়লেন, দৌড়াদৌড়ি করে অভ্যাস নেই বহুদিন, হঠাৎ এতটুকু পথ দৌড়ে এসে তার পায়ের মাংসপেশিতে কোথায় জানি টান পড়েছে। একপায়ে খোঁড়াতে খোঁড়াতে একটা চেয়ারে বসে তিনি ঘরের চারিদিকে তাকালেন। চারপাশে মিষ্টির বাক্স, রুইমাছ, কমলার আঁকা আর উপহারের বাক্স। ফারুখ বখত জিজ্ঞেস করলেন, “এগুলি কী?”
“উপহার।”
“কার জন্যে উপহার?”
“আমার জন্যে। ফরাসত আলি মিটিমিটি হাসতে হাসতে বললেন, “আগে বুঝতে পারিনি কেন, এখন বুঝেছি। সবাই উপহার নিয়ে এসেছে আমার লটারির টিকেট কিনতে।”
ফারুখ বখত ভয়ে ভয়ে বললেন, “বিক্রি করে দিসনি তো?”
“না, দিইনি! একটা বইয়ের মাঝে রেখেছিলাম, বইটা তখন খুঁজে পাইনি, কপাল ভালো!”
“এখন পেয়েছিস?”
“হ্যাঁ। এই দ্যাখ।”
দুজন মিলে তারা তখন ছোট লটারির টিকেটটার দিকে তাকিয়ে রইলেন, এইটুকু একটা কাগজ, কিন্তু সেটার দাম এখন তিরিশ লক্ষ টাকা বিশ্বাস হতে চায় না।
ফরাসত আলি খানিকক্ষণ পর একটা নিঃশ্বাস ফেলে বললেন, “বিকালবেলা সবাই আসবে টিকেট কিনতে। এখন কী করি?”
ফারুক বখত দাঁত বের করে হেসে বললেন, “দাঁড়া, ব্যাটাদের দেখাই মজা! কত বড় জোচ্চোর–তোর কাছ থেকে ঠকিয়ে লটারির টিকেটটা কিনে নিতে চাইছিল!”
“কী করবি?”
“আগে চল টিকেটটা সেফ ডেপোজিট বক্সে জমা দিয়ে আসি। আর দরজায় একটা চিঠি লিখে রেখে যা যে তুই লটারির টিকেটগুলি একটা খামে ভরে টেবিলের উপর রেখে যাচ্ছিস সবাই মিলে যেন ভাগাভাগি করে নেয়।”
.
সেদিন বিকালবেলা একটা এ্যাম্বুলেন্স প্রফেসর রইসউদ্দিন, কাস্টমসের এমাজউদ্দিন, ডাক্তার তালেব আলি তার অ্যাডভোকেট আবদুল করিমকে ফরাসত আলি বাসা থেকে হাসপাতালে নিয়ে গেল। তারা একজন আরেকজনের সাথে মারপিট করে রক্তারক্তি অবস্থা করেছেন। যারা ব্যাপারটা দেখেছে তারা বলেছে নিজের চোখে না দেখলে এই দুর্ধর্ষ মারপিট নাকি বিশ্বাস করা শক্ত। একটা খাম নিয়ে একজন নাকি আরেকজনের উপর ঝাঁপিয়ে পড়ছিলেন, কিল-ঘুষি-চড়-লাথি মেরে খামচি দিয়ে চুল টেনে এক বিতিকিচ্ছিরি অবস্থা। পাড়ার ছেলেরা এসে অনেক কষ্টে তাদের আলাদা করে হাসপাতালে এ্যাম্বুলেন্সের জন্য ফোন করেছে।
০২. তিরিশ লক্ষ টাকার উত্তেজনা
তিরিশ লক্ষ টাকার উত্তেজনা কমতে অন্তত তিরিশ দিন লাগার কথা ছিল, কিন্তু ফরাসত আলি আর ফারুখ বখত সপ্তাহখানেকের মাঝে নিজেদের সামলে নিলেন। পরের শনিবারের মাঝে তাদের ভাবভঙ্গি দেখে মনে হতে লাগল লটারি জেতা বুঝি নিত্তনৈমিত্তিক ব্যাপার। পরিচিত মানুষজন অবিশ্যি ব্যাপারটা এত সহজে নিতে পারল না, বেশির ভাগই হিংসায় জ্বলে পুড়ে খাক হয়ে গেল। আবার অনেকে যারা আগে কোনোদিন ফরাসত আলি আর ফারুখ বখতকে মানুষ হিসেবে গণ্য করেনি হঠাৎ করে তারা ফরাভাই এবং ফারুভাই বলতে অজ্ঞান হয়ে যেতে শুরু করল। ফরাসত আলি এবং ফারুখ বখত একদিন তাঁদের এই পরিচিত মানুষজনকে লুকিয়ে ঘরের দরজা বন্ধ করে বসলেন টাকাটা কীভাবে খরচ করা যায় সেটা ভেবেচিন্তে বের করতে। তাদের সামনে দুই কাপ চা, একটা সোলার পাওয়ার ক্যালকুলেটর, এক রিম কাগজ আর দুইটা বলপয়েন্ট কলম। ফরাসত আলি গোলাপি রঙের একটা চিরুনি দিয়ে তাঁর দাড়ি পাট করতে করতে চিন্তা করতে লাগলেন, যে-দাড়ি কামানোর জন্যে রেজর কিনতে গিয়ে তিনি এতগুলি টাকা পেয়ে গেছেন হঠাৎ করে তাঁর সেই দাড়ির জন্যে একটু মায়া পড়ে গেছে, দিনরাত সেটা কুটকুট করলেও তিনি আর সেটা কেটে ফেলছেন না। খানিকক্ষণ ছাদের দিকে তাকিয়ে চিন্তা করতে করতে হঠাৎ করে বললেন, “আমার বড় রেলগাড়ির শখ। একটা রেলগাড়ি কিনলে কেমন হয়?”